বাংলাদেশের সিনেমার উন্নয়ন নিয়ে বছর বছর অসংখ্য সভা হয়, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার পরিকল্পনা হয়, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের (বিশেষ করে কলকাতার প্রযোজকদের) আনাগোনাও বাড়ে দ্বিগুণ হারে। এমনকি নায়ক-নায়িকা সংকট ঠেকাতে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিশাল আকারে রিয়েলিটি শোর আয়োজনও চোখে পড়ছে টিভি চ্যানেলগুলোয়। কিন্তু এত সব আয়োজন করে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির কী আদৌ কোনো উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হচ্ছে? গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, চলতি বছরের অন্যতম বড় উত্সব ঈদ ধরে ছবি নির্মাণের সংখ্যা, তাতে নায়ক-নায়িকার উপস্থিতি আর ইন্ডাস্ট্রির সাম্প্রতিক গতিবিধির দিকে নজর দিলেই উত্তর মিলবে কিছুটা হলেও।
এ বছর ঈদুল ফিতরের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। তবে আশ্চর্য হলেও সত্য, প্রেক্ষাগৃহে ঠিক কতটি ছবি মুক্তি পাবে, তা এখন পর্যন্ত জানে না খোদ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতিও। সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন টকিজকে বলেছেন, ‘এখনো ছবি মুক্তির বিষয়গুলো চূড়ান্ত হয়নি।’ এদিকে সম্ভাব্য মুক্তির তালিকায় ঘুরেফিরে যে ছবিগুলোর নাম বারবার আসছে, সেগুলো হলো— বুলবুল বিশ্বাস পরিচালিত ‘রাজনীতি, শাহাদাত্ হোসেন লিটনের ‘অহংকার’, জয়দ্বীপ মুখার্জির ‘নবাব’, বাবা যাদবের ‘বস টু’ ও আবদুল মান্নানের ‘রংবাজ’। খেয়াল করলে দেখা যাবে, পাঁচটি ছবির মধ্যে বস টু বাদে চারটিরই নায়ক হিসেবে থাকছেন যথারীতি শাকিব খান। তার বাইরে দ্বিতীয় কোনো বাংলাদেশী নায়কের ছবি এ ঈদে থাকছে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের কেউ তো নয়ই উল্টো শাকিবের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নামার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ওপার বাংলার অভিনেতা জিতের। সেন্সর জটিলতা পেরোতে পারলেই বস টু নিয়ে জিত্ জোরেশোরে এগোবেন, এরও ইঙ্গিত রয়েছে বস টু ছবির সাম্প্রতিক প্রচার-প্রচারণায়। তার মানে বাংলাদেশের ছবিতে এ মুহূর্তে শাকিবের প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে কলকাতার নায়কই, এ দেশের কেউ নন।
এবার আসা যাক, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির চলমান অস্থিরতা প্রসঙ্গে। চলতি বছর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের মধ্যে যে কথার যুদ্ধ উকিল নোটিস চালাচালি হয়েছে, তাকে এককথায় দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের বছরই বলা চলে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, একজন মাত্র নায়ককে (শাকিব খান) কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন এফডিসিতে কোনো শুটিংই হয়নি, এ রকম ঘটনা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এর আগে দ্বিতীয়বার ঘটেনি।
শাকিব-অপু বিশ্বাসের বিবাহিত জীবনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রপাত হয় এ সময়। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সঙ্গে শাকিব খানের দ্বন্দ্ব, এর পর তাকে ও নির্মাতা শামীম আহমেদ রনিকে এফডিসিতে সাময়িক নিষিদ্ধ করা, একপর্যায়ে অভিনেতা বাপ্পারাজসহ আরো বেশ কয়েকজন অভিনেতা কুশলীর সঙ্গে এফডিসি প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ওই শাকিব খান। বলা চলে, নায়ক শাকিব খানকে ঘিরেই এ বছরের এখন পর্যন্ত পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কার্যাবলি এগিয়ে চলছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে এত উন্নয়নের কথা কী শুধুই কথার কথা? এই সময় এসেও পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি একজন মাত্র নায়কের ওপর নির্ভর করছে? এ দ্বারা কিছু সিনেমা ব্যবসায়িক সাফল্য পেলেও আদৌ কী তা গোটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য মঙ্গলজনক? এ নিয়ে কথা হয় গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও শিক্ষক সুমন রহমানের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথার প্রসঙ্গটি ছিল: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছবি মুক্তি দেয়ার অন্যতম প্রধান সময় ঈদ। ঈদকে উপলক্ষ করে নানা ধরনের সিনেমা নির্মিত হবে, প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে এবং দর্শক তা উপভোগ করবে— এমন একটা সময়ের জন্য সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও অপেক্ষা করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দিন দিন তা সংকুচিতই হয়ে যাচ্ছে। এর পর সুমন রহমান তার কথার শুরুটা করেন এভাবে: ‘একটা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যে মৃতপ্রায় দশায় পৌঁছে গেছে এর চেয়ে (আসছে ঈদ উপলক্ষে সম্ভাব্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা পর্যবেক্ষণ করে) ভালো প্রমাণ তো আর নেই। একটা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে সুপার স্টার থাকতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই নায়কই সবকিছুকে মনোপোলাইজ করবে। সমস্যাটা হচ্ছে, শাকিবের মতো মনোপোলাইজ করার ক্ষমতা এই ইন্ডাস্ট্রির অন্য কোনো অভিনেতার নেই।
শধু এ বছর নয়, গত কয়েক বছরের ঈদের ছবি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরিচিত নায়ক, পরিচিত গল্প মোটকথা, একটু জাঁকজমক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে ফর্মুলাভিত্তিক ছবি বানানোর রীতি দাঁড়িয়ে গেছে এখানে। যার মূল উদ্দেশ্য থাকে, বিনিয়োগকৃত টাকা তুলে আনা। এই অর্থলগ্নি যেন ঝুঁকিতে না পড়ে সে কারণে প্রযোজকরা নতুন ধরনের সিনেমা নির্মাণ পরিকল্পনা তো করেননি, বরং সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়কের উপস্থিতি দিয়েই ঝুঁকি থেকে পার পেতে চান। যে কারণে উদ্যোক্তার বদলে ঈদের ছবির বিনিয়োগে ফাটকা ব্যবসায়ীদেরও আনাগোনা বাড়ে। বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করেন সুমন রহমানও। তিনি বলেন, ‘যত বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে, তত বেশি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিও এগোবে। একজন উদ্যোক্তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, তিনি ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। যে কারণে সিনেমার উন্নয়নে তিনি ভিন্ন ধরনের গল্প, নতুন নায়ক, অপরিচিত একজন নির্মাতাকে নিয়ে তিনি হাজির হবেন।’ একই সঙ্গে তিনি পাশের দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, ভারতীয় নির্মাতারা স্টারইজম প্রথা থেকে বের হয়ে অপরিচিত নির্মাতা, নায়ক নিয়ে ছবি নির্মাণ করছে এবং ব্যবসায়িকভাবেও লাভবান হচ্ছে। সেখানে উদ্যোক্তা আছেন, আমাদের দেশে নেই। কারণ, ইন্ডাস্ট্রির মৃতদশার মধ্যে কোনো প্রযোজক এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করতে কেউ রাজি নন। যে কারণে, শাকিব খানদের দিয়েই তারা ছবি বানিয়ে নিশ্চিত থাকতে চান। এভাবেই হয়তো এ দেশের সিনেমায় এক একজন শাকিব খান আসতে থাকবেন।
এদিকে ঈদের মতো বড় উত্সবেও দর্শক সাড়া না পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে মানসম্মত প্রেক্ষাগৃহের অভাবকে দায়ী করছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘আমি মূলধারার ছবির সঙ্গে জড়িত নই। তবুও বলবো, বাস্তবতা এ রকমই যে, ঈদ ছাড়া বাংলাদেশে তেমনভাবে চলচ্চিত্র দেখার কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না দর্শক। কারণ আমাদের দেশে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য ভালো প্রেক্ষাগৃহ নেই। আমার মনে হয়, প্রেক্ষাগৃহ বাড়লে সেখানে গিয়ে ছবি দেখার ক্ষেত্রে দর্শক আগ্রহ বাড়বে, এর ফলে বেশি বেশি সিনেমা নির্মাণ হবে, নানা রকম গল্প আসবে, অভিনেতাও বাড়বে। তা না হলে একমাত্র ঈদকে ঘিরেই ছোট এই ইন্ডাস্ট্রি একজন নায়ক দ্বারা নিমজ্জিত থাকবে।
সিনেমার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষকদের এমন কথা এটাই প্রমাণ করে, একজনমাত্র নায়ক কিংবা ঈদের মতো উত্সবকে ধরেই শুধু ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা চলচ্চিত্রকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেবে না। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নিতে চাইলে বিদ্যমান প্রথাগুলো সংস্কার করে সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, সরকার সবাইকে নতুন ভাবনা যুক্ত করতে হবে।