বিজ্ঞান প্রযুক্তি ডেস্কঃ দক্ষিণ কলকাতার এক মনোবিদের চেম্বার। বিকেল। দৈনন্দিনের রুটিন মতো রোগী দেখছেন তিনি। কিন্তু সে দিন এমন এক কেস হ্যান্ডেল করেছিলেন যা তাঁকেও চমকে দিয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই মনোবিদ জানাচ্ছেন, এমন অনেক কেস হ্যান্ডেল করেছেন যেখানে পুতুল নিয়ে ভুলে থাকেন মা। পুতুলকেই নিজের সন্তান মনে করেন। তীব্র মানসিক আঘাত থেকে তাঁদের ওই অবস্থা। কিন্তু সেটা কখনওই সর্বজনীন অভ্যেস নয়। তবে তাঁর ওই পেশেন্ট এমন এক পুতুলের ছবি দেখেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় যাকে নকল ভাবাটাই কঠিন। তাঁরও তেমনটাই চাই! কেমন সেই পুতুল?
লালচে গায়ের রং। হালকা কোঁচকানো গায়ের চামড়া। মাথা ভর্তি চুল হয়েছে তার…। নিশ্চিন্তের ঘুম দিচ্ছে ছানা। এই পর্যন্ত এক্কেবারে ঠিক। দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই কয়েক ঘণ্টা মাত্র বয়স শিশুটির। আপাতত হয়তো ঠিকানা নার্সিংহোম। দিন কয়েকের মধ্যেই মায়ের সঙ্গে বাড়ি চলে যাবে।
এখানেই ভুলটা করলেন আপনি। শিশুটি তো মানুষই নয়। মায়ের সঙ্গে বাড়ি যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?
অবাক হচ্ছেন। ভাবছেন, এমন ভুল কথা লেখা হল কী করে? না! ভুল নয়। এখনও হলফ করে বলা যায়, শিশুটি মানুষ নয়। তা হলে?
বলতে পারেন এটি একটি পুতুল। প্ল্যাটিনাম কিওর্ড সিলিকন (platinum cured silicone) দিয়ে তৈরি। কিছু কিছু কসমেটিক সার্জারির ক্ষেত্রে এই সিলিকন ব্যবহার করা হয়। দেখতে আসল মানব শিশুর মতোই। দূর থেকে তো বটেই, সামনাসামনি দেখেও চট করে তফাত্ বের করা মুশকিল। কারণ দৈর্ঘে, প্রস্থে এমনকি ওজনেও আসলের সঙ্গে এক্কেবারে মানানসই!
তৈরি হয় কোথায় ?
ঠিকানা স্পেন। উত্তর স্পেনের বিলাবাও শহর থেকে ১৫ মিনিটের দূরত্বে রয়েছে লিওনা মিউনিসিপ্যালিটি। সেখানেই রয়েছে এই ‘ক্লোন’ ফ্যাক্টরি। ডিরেক্টর ক্রিস্টিনা ইগনেসিয়াসের দাবি, পৃথিবীতে একমাত্র তাঁর কারখানা থেকেই এ হেন বেবি ক্লোন তৈরি হয়। কখনও অর্ডার অনুযায়ী বেবি ডল তৈরি করে দেন ক্রিস্টিনার টিম। সেখানে রেফারেন্স হিসেবে থাকে আসল কোনও মানব সন্তানের ছবি। কখনও বা ক্রেতা নিজের পছন্দ মতো বেবি ডলের ত্বক, চুলের রঙ বা হাত-পায়ের গড়ন অর্ডার দেন। কখনও বা ক্রিস্টিনা নিজের শিল্পসত্তা ফুটিয়ে তোলেন বেবি ডলের মধ্যে।
শুরু কী ভাবে ?
সাত বছর আগে এই ধরনের স্পেশাল এফেক্টস ওয়ার্কশপের কাজ শুরু করেন ক্রিস্টিনা। ২০১৩ থেকে লঞ্চ করেন তাঁদের বেবি ক্লোন ব্র্যান্ড। স্পেনে এই ব্র্যান্ডের ডিস্ট্রিবিউটার সিলভিয়া অর্টিজের মাথায় প্রথম এই ‘হাইপার রিয়্যালিস্টিক’ পুতুল তৈরির আইডিয়া আসে। তিনি ক্রিস্টিনার সঙ্গে তা শেয়ার করেন। ক্রিস্টিনা ভেবেছিলেন, এটা খুব অদ্ভুত ধারণা। সিলিকন দিয়ে যে বেবি ডল তৈরি করা যায়, সেটা তিনি ভাবেননি। কেন মানুষ এই ধরনের পুতুল পছন্দ করবেন, সেটাও তাঁর প্রশ্ন ছিল। একটা-দু’টো করে এ ধরনের পুতুল তৈরি করার পর দেখা গেল, সেগুলি বিক্রি হচ্ছে। চাহিদাও ভাল। তখনই এটা নিয়ে বড় আকারের ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবেন তিনি। সিনেমায় ব্যবহার হয় এমন কিছু টেকনিকও এই ধরনের পুতুল তৈরিতে কাজে লাগান ক্রিস্টিনা।
কী ভাবে কাজ হয় ?
১০ জন কর্মী নিয়ে এই ধরনের পুতুল তৈরির কাজ শুরু করেন সিলভিয়া ও ক্রিস্টিনা। প্রথম ধাপটাই সবচেয়ে কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। প্লাস্টিসাইন দিয়ে প্রথমে একটি মূর্তি তৈরি করে নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় ফাইবারগ্লাস ও অ্যালুমিনিয়ামের কাজ। সূক্ষ্ম উলের মতো একটি দ্রব্য, যার পোশাকি নাম মোহেয়ার (mohair), দিয়ে তৈরি হয় বেবি ডলের চুল। আসলে ওই ফ্যাব্রিকটি অনেকটা মানুষের চুলের কাছাকাছি মেটিরিয়ালে তৈরি। প্রায় তিন মাস সময় লাগে গোটা পদ্ধতিটি শেষ হতে।
মাত্র কয়েক বছর স্পেনের বিলবাওতে শুরু হয়েছে রিবর্ন ফেস্টিভ্যাল। উত্তর স্পেনের এই শহরে ফেস্টিভ্যাল শুরু হলেও জার্মানিতে সদ্য এর নতুন করে ক্রেজ চালু হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন অদ্ভুত ডিজাইনের ‘বেবি অবতার’ও পাওয়া যায়। ঠিক জেমস ক্যামেরুন পরিচালিত ‘অবতার’ সিনেমায় দেখা প্রাণীদের মতো। ত্বক বা চুলের রঙ, এমনকী ‘শিশু’ ছেলে হবে না মেয়ে তাও নির্ভর করে ক্লায়েন্টের পছন্দের কথা মাথায় রেখে। আর যেখানে কোনও শিশুর শৈশব রূপকে ধরে রাখতে হয় পুতুলে, সেখানে পারফেকশনিস্ট হতে হয় অনেক বেশি। ক্রিস্টিনা বলছেন, ‘‘আমরা খুব স্পেসিফিক অর্ডার পাই। শিশুর শরীরের কোনও বিশেষ অংশে জন্মদাগ থাকলে সেটাও পুতুলের মধ্যে তৈরি করে দিতে বলা হয়।’’
দাম ?
এমন কিছু পুতুল তৈরি হয় যারা চলা-ফেরা করতে পারে। মুখ দিয়ে বিভিন্ন আওয়াজও বের করে। এগুলির দামই সবচেয়ে বেশি। ভারতীয় মুদ্রায় ২ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬১৫ টাকার মতো। অবতার বেবির দাম ভারতীয় মুদ্রায় ১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৩৩০ টাকা। এ ছাড়া বেসিক পুতুলগুলো পাওয়া যায় ১৬ হাজার টাকা থেকে ৬৬ হাজার টাকার মধ্যে।
ক্রেতা কারা ?
মূলত বেবি ডলের চার ধরনের ক্রেতা পেয়েছেন ক্রিস্টিনা ও তাঁর টিম।
১) একদল বাবা-মা তাঁদের সন্তানের ছোট বয়সের ছবি পাঠান। সন্তান বড় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার ছোটবেলার একটি রেপ্লিকা রেখে দিতে চান নিজের কাছে।
২) একদল যাঁদের সন্তান নেই, দত্তকও নেবেন না, তাঁরা নিজেদের পছন্দ মতো পুতুল অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে নিয়ে যান।
৩) একদল যাঁরা এমন ধরনের পুতুল সংগ্রহ করে রাখেন।
৪) আর একদল যাঁরা নিজেরাই রিবর্ন আর্টিস্ট। এই ফেস্টিভ্যাল থেকে যাঁরা ছাঁচ অবস্থায় বেবি ক্লোন কিনে নেন। সেটা রং করে নিজেদের মতো করে বেবি ডল তৈরি করিয়ে সংগ্রাহকদের কাছে বা সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেন।
ক্রেতার কি খোঁজে ?
প্রশ্নটা ওঠেই! জীবন্ত শিশুর বিকল্প হিসেবে যে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষটি আসলের মতো দেখতে পুতুল নিয়ে যাচ্ছেন ঘরে, তাঁর মনের অবস্থাটা কি কোথাও একটু অন্য রকম? আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা? অস্বাভাবিক?
যে সব অভিভাবক তাঁদের সন্তানের ছোটবেলা ‘ধরে রাখতে’ চান পুতুলে তাঁদের মনের হদিশ পাওয়া বরং তুলনামূলক সহজ। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, অনেক বাবা-মায়েরই মনে হয় সন্তান যখন ছোট থাকে যেন তখনই ভাল, সন্তানের ছোটবেলাটা মিস করেন তাঁরা। আসলে সন্তান বড় হলে বাবা-মায়ের সঙ্গে মতান্তর, মনান্তরে গ্লানি জমতে পারে। সে জন্য হয়তো ওই সময়টা খুঁজে পেতে চাইছেন তাঁরা। ‘‘সন্তানের ছোটবেলার সঙ্গে জুড়ে থাকার তাগিদ থেকেই সন্তানের ছবি পাঠিয়ে ঠিক তার মতো দেখতে একটা পুতুল তৈরি করিয়ে নিজেদের কাছে রাখছেন বলে আমার মনে হয়’’ বললেন অনুত্তমা। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, ‘‘জীবন তো এগিয়ে চলে। সন্তান বড় হয়। তার সেই বড় হওয়াটাকে মেনে নিতে হয়। জীবনের সেই এগনোটা মেনে না নিয়ে পিছনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলে সেটা বদ্ধ মানসিকতা।’’ ‘ক্রিস্টাল মাইন্ড’-এর ডিরেক্টর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ রিমা মুখোপাধ্যায় মনে করেন, অনেক সময় সন্তান বড় হয়ে গেলেও তাকে কোলে নেওয়ার, আদর করার ইচ্ছে থেকে যায় কারও কারও। কোনও দায়িত্ব ছাড়াই এ ক্ষেত্রে তাঁরা সেই আনন্দ পাচ্ছেন।
আর নিঃসন্তান দম্পতিদের মানসিকতা? অনুত্তমার ব্যখ্যা, ‘‘অনেক নিঃসন্তান দম্পতি পোষ্যকে সন্তান স্নেহে লালন করেন। এটাও তারই একটা নামান্তর। ইচ্ছেপূরণের কাল্পনিক জগতের রূপান্তর।’’ নীলাঞ্জনা মনে করেন এটা কোথাও আত্মকেন্দ্রিকতা এবং অবসেসিভ থট ওরিয়েনটেশন। তার কারণ? তিনি শেয়ার করলেন, ‘‘সন্তান না থাকলে তা কামনা করবেন কেউ। এটাই তো স্বাভাবিক। যদি দত্তক নেন, তাকে খাওয়ানো, পরানো, বড় করা…। কিন্তু এক্ষেত্রে সন্তান পালনের দায়িত্বের বাস্তবসম্মত মানসিকতা নেই। সবটাই কাল্পনিক সুখ। তার মধ্যে দায়িত্ব নেই।’’ রিমা বিষয়টিকে দু’ভাবে ব্যখ্যা করলেন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকে নিজেরাই আজীবন বাচ্চা থেকে যায়। স্ট্রেস হ্যান্ডেল, দায়িত্ব নেওয়া এ সবে এরা ইমোশনালি ইমম্যাচিওর। তারা সন্তান চায় না। সন্তানের সঙ্গে যে দায়িত্বের প্যাকেজটা থাকে সেটা চায় না। ফলে এর মাধ্যমে যদি খুশি থাকে তা হলে ভাল। অন্তত একটা শিশুকে পৃথিবীতে এনে, তার পর তার দায়িত্ব পালন করতে না পারাটা অন্যায়। তার থেকে এটা ভাল। আনওয়ান্টেড একটা শিশুরও পৃথিবীতে আসা উচিত নয় বলে মনে করি আমি।’’
এই ধরনের মানসিকতা কি অসুস্থতার ইঙ্গিত?
মনোসমীক্ষক ঝুমা বসাক মনে করেন, সামাজিক প্রগতির জন্য আমাদের কিছু না পাওয়ার ফাস্ট্রেশনও বহন করতে জানতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা এমন একটা সামাজিক স্তরে পৌঁছে যাচ্ছি যেখানে সব কিছুই কিনে ফেলা যায়। সন্তান তো আসলে মানুষ। পুতুল কি তার বিকল্প হতে পারে? এটা খুব অ্যালার্মিং কনসার্ন।’’ অনুত্তমা মনে করেন, যে দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সেখানে একাকিত্ব এমনিতেই বেশি। সন্তানের সাহচর্য পাবার বাস্তবতা অনেকদিনই উড়ে গিয়েছে। তবে বাস্তব তো তার নিজস্ব দাবি নিয়ে আসবেই। তাঁর কথায়, ‘‘এটা রোগ কিনা বলতে গেলে ওই বাবা-মায়েদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মনোসামাজিক পরিস্থিতি বিচার করতে হবে। তবে কল্পনা আর বাস্তবের ব্যবধানরেখা গুলিয়ে ফেললে সেটা সমস্যা।’’ নীলাঞ্জনা স্পষ্ট বললেন, ‘‘আমি যদি ঘর সাজানোর জন্য পুতুল কিনতে চাই সেটা পজিটিভ। কিন্তু পুতুলকে যখন মানুষ জ্ঞান করে তার সঙ্গে আমার ইমোশনগুলো জড়িয়ে ফেলছি, তখন সেটা সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়।’’
ঠিক এ কথারই যেন প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে ক্রিস্টিনার গলাতেও। অনেক সময়ই আসল সন্তানের বদলি হিসেবে সিলিকন বেবিদের ব্যবহার করেন বাবা-মায়েরা। সেক্ষেত্রে ক্রিস্টিনার কথা, ‘‘সিলিকন বেবিরা কিন্তু আসল নয়। তাদের কখনও জন্ম হয় না। এগুলো শুধু সংগ্রহের জন্য। মনে রাখতে হবে আমরা একটি কারখানা, সন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন নই।’’
কাস্টমাইজড পেরেন্টহুড
আপনার সন্তান বাহ্যিক দিক থেকে কেমন হবে, তা কিন্তু আপনার জানা নেই। আপনি সেটা কন্ট্রোলও করতে পারেন না। হয়তো আপনার মতো চাপা গায়ের রঙ, আর সঙ্গীর মতো কোঁকড়া চুল নিয়ে জন্মালো সে। কিন্তু বাবা-মা হিসেবে আপনাদের হয়তো সন্তানের ফর্সা ত্বক বা স্ট্রেট চুল পছন্দ ছিল। সেই কন্ট্রোল তো আপনাদের হাতে নেই। সেখান থেকেই কি কোথাও এই পুতুলের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে মানুষের? ঠিক যেন বাচ্চাকেও আমি অর্ডার দিলেই পেয়ে যেতে পারি। এ যেন ঠিক পছন্দমতো কুমোরটুলি থেকে গড়িয়ে নেওয়া। প্রশ্ন তুলেছেন অনুত্তমা। তাঁর কথায়, ‘‘এ যেন সন্তানকে হাতের পুতুল করে পেতে চাওয়া। নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে চাওয়া। সেখান থেকেই মনে হচ্ছে, এটার কি খুব দরকার ছিল?’’ ঝুমার মতে, ‘‘সন্তান কিনে নিলে তার মধ্যে তো কোনও পেরেন্টহুড নেই। তাকে বড় করে তোলাই তো পেরেন্টহুড। এখানে তো সন্তান হওয়ার ইচ্ছেটাকেও যেন কিনে নিচ্ছে। আমি উদ্বিগ্ন।’’
তামাগোচি এফেক্ট
ন’য়ের দশকের শেষের কথা। ভার্চুয়াল গেম তামাগোচির কথা আপনাদের মনে পড়ে? ১৯৯৬-এর শেষ দিকে জাপানে তৈরি হয় এই খেলা। ১৯৯৭-এর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। ২০১০-এর হিসেব বলছে, বিশ্ব জুড়ে সাত কোটি ৬০ লক্ষ তামাগোচি বিক্রি হয়েছিল। ডিম্বাকৃতি এই ভার্চুয়াল পেট সিমুলেশন গেম তৈরি করার জন্য ১৯৯৭-এ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তামাগোচির সৃষ্টিকর্তা আকি মাইতা। এই খেলায় ভার্চুয়ালি একটি পোষ্য তৈরি হত। পোষ্যটিকে ভিন গ্রহের প্রাণী হিসাবে দেখানো হত। একটি চাবির রিংয়ের আকারের যন্ত্রের মধ্যে ‘থাকত’ একটি ডিম। খেলোয়াড় ওই যন্ত্র কেনার কয়েক মিনিটের মধ্যে ডিম ফেটে তামাগোচি ‘জন্মাতো’। এর পর ইচ্ছেমতো সেই পোষ্যের যত্ন নিতে পারতেন খেলোয়াড়। পোষ্যের খিদে পাওয়া, তার খুশি হওয়া সবটাই ভার্চুয়ালি কন্ট্রোল করতে পারতেন খেলোয়াড়। তাকে খেতে দেওয়া, পরিচ্ছন্ন রাখা, ঘুম পাড়ানো, এমনকী ঘুমের সময় আলো পর্যন্ত নিভিয়ে দিতে হত খেলোয়াড়কে। পোষ্য অসুস্থ হলে ওষুধ দিতে হত। খেয়াল না রাখলে বা অতিরিক্ত অসুস্থ হলে ‘মৃত্যু’ পর্যন্ত ঘটতে পারত পোষ্যের। অর্থাত্ আসল পোষ্যর দায়িত্ব না নিয়ে ভার্চুয়াল গেমের মাধ্যমে কাল্পনিক আনন্দ পাওয়ার প্রয়াস। তামাগোচিতে মানুষ যে আনন্দ পেতেন, বেবি ডলকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই কোথাও একই অনুভূতি কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ।
‘দায়িত্ব’ না থাক, একটু যত্ন লাগবে
বছরে একবার করে এই ধরনের পুতুল পরিষ্কারের পরামর্শ দিচ্ছেন ক্রিস্টিনা। তাতেই নাকি আগামী ৩০ বছর পর্যন্ত অটুট থাকবে এই বেবি ডল। কিন্তু যদি পুতুলটিকে নিয়ে কাপড়ে মুড়ে মাঝেমধ্যে বাড়ির বাইরে যাওয়ার অভ্যেস থাকে কারও তা হলে দু মাস অন্তর পরিষ্কার করতে হবে।
ইম্পোর্ট হচ্ছে কোথায়?
সবচেয়ে বেশি এই ধরনের বেবি ডল ইমপোর্ট হয় আমেরিকায়। এর পরের তালিকায় রয়েছে অস্ট্রিয়া, জাপান, কলম্বিয়া, ব্রাজিল ও ইরান। ক্রিস্টিনা বললেন, ‘‘স্পেনে এই ধরনের পুতুল সংগ্রহ করাটা অনেকেরই অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য দেশের ক্রেতারা কিন্তু শিল্পেরও মর্যাদা দিচ্ছেন।’’
আজ ভারতে এই বাণিজ্যিক মেলার কথা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন না। এ দেশের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো হয়তো সেই ভাবনাকে সাপোর্ট করে না। তবে কয়েক বছর পর এ দেশেও যে এমন প্রচলন হবে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারেন না। রিমার কথায়, ‘‘আমরা তো পাশ্চাত্যকে খুবই নকল করি। তাই ভারতেও এটা হতেই পারে। এখন যাঁরা সফট টয় পছন্দ করেন তখন হয়তো তাঁদের এগুলো ভাল লাগবে।’’ আবার সন্তান মারা যাওয়ার পর মৃত সন্তানের ছবি নিয়ে ক্রিস্টিনার কাছে পুতুল তৈরির অর্ডার নিয়ে এখনও পর্যন্ত কেউ আসেননি। কয়েক বছর পর সেটা হওয়াও বিচিত্র নয়। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এটাই মক টেস্টের আকার নেবে! ঠিক যেমন সেনাদের প্রথমে ব্ল্যাঙ্ক বুলেট দিয়ে প্র্যাকটিস করানো হয়, তেমনই সন্তান জন্মানোর আগে হবু মা কী ভাবে তাকে কোলে নেবেন, কী ভাবে খাওয়াবেন তারও অভ্যেস করে নেওয়া হবে এই বেবি ডল দিয়েই!