এক বছর আগে গুলশানের কূটনীতিক পাড়ায় নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় নিহতদের স্মরণ করা হয়েছে ফুল আর ভালোবাসায়। নৃশংস এই হামলার ঘটনায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গুলশানের সেই হলি আর্টিজানে মিশেছিল সব পথ। বিদেশি কূটনীতিক, রাজনীতিক, নিহতদের স্বজন ও সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নিহতদের প্রতি। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় ঘটনাস্থলে সাময়িকভাবে স্থাপিত স্মৃতির বেদি। শ্রদ্ধা জানাতে আসা সবারই কণ্ঠে ছিল একই উচ্চারণ। ধর্মের নামে এমন নৃশংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান। দীর্ঘ এক বছর পর গতকাল সকাল ৯টার দিকে গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারির প্রধান ফটক সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেয়া হয়। তার আগে সকাল সাড়ে সাতটার পর সেখানে গিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ও জাইকার প্রতিনিধি। এর দু’ঘণ্টা পর থেকে সেখানে সাধারণ দর্শনার্থী আসতে শুরু করে। আসতে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। সকাল ১০টার দিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ওবায়দুল কাদের বলেন, এক বছর আগের সেই ভয়াল স্মৃতি আমাদেরকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই ঘটনা আমাদের জীবনধারা বদলে দিয়েছে। সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা সংগ্রামী জাতি। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে জানি। আন্তর্জাতিকভাবে সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি আমরা জঙ্গি দমন করতে পারবো। আমাদের সাহসী পুলিশ বাহিনী তা পেরেছে। ফ্রান্স এবং লন্ডনের পুলিশ যা পারেনি, আমাদের পুলিশ তা করতে পেরেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে অপারেশন থান্ডার বোল্ট পরিচালনা করেছে তাও আমাদের জন্য গর্বের। এখানে ৭১-এর সাহসিকতার পুনরুজ্জীবনই প্রদর্শন হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, তবে আমরা মনে করি জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে, নির্মূল হয়নি। ওই অশুভ শক্তির হাত থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর নির্ভর করলে হবে না। জনগণকে সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ মিছিল করলে হবে না। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়াতে হবে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতাকারীদেরকেও প্রতিরোধ করতে হবে। এ সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, উপ-প্রকাশনা সম্পাদক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম আমিনসহ নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর নিহতদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক ও বন্ধুত্বপূর্ণ। কখনো ভাবতে পারিনি যে, বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। কোথাও না কোথাও আমাদের সচেতনতার ঘাটতি ছিল। হয়তো বুঝতে পারিনি। আমাদের সন্তানরাই এমন কাজ করছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমন করছে। এদিকে বিএনপি’র পক্ষ থেকে নিহতদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
ইতালিয়ান রাষ্ট্রদূতসহ দূতাবাসের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ শ্রদ্ধা জানাতে যান। তিনি সহকর্মীদের নিয়ে কিছুক্ষণ প্রার্থনাও করেন। এরপর সে স্থান ত্যাগ করেন। তখন তাদের একাধিক কর্মকর্তাকে চোখের পানি মুছতে দেখা গেছে। তাছাড়া আরো কয়েকজন বিদেশিকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) পক্ষে ফুল দেন দলের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব নাদের চৌধুরী। ফুল দেয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সবাইকে সচেতন করে এ ধরনের হামলা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। জঙ্গিবাদের বীজ সমাজ থেকে উৎপাটন করতে হবে। সংগঠনের পক্ষে ফুল দেয়ার পর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে পুলিশের যথেষ্ট সাফল্য থাকলেও তা নির্মূল করতে অনেক কিছু করতে হবে। এসব জঙ্গির মূলে রয়েছে মওদুদীবাদীসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী ধর্মীয় দর্শনগুলো। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ধর্মের নামে অন্য ধর্মের লোক, ভিন্ন মতের লোক ও বিদেশি হত্যা বন্ধ করতে হবে।
হলি আর্টিজানে নিহত ইতালিয়ান নাগরিক নাদিয়া বেনেদেত্তি-এর ননদ সামিনা রাখানু এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি বলেন, আজকের দিনটি আমার পরিবারের জন্য খুব বেদনাবিধুর। অনেক কষ্ট নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। গত এক বছর আগে আমার ভাবি জঙ্গিদের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিলেন। তাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, তাকে আমরা খুব গভীরভাবে মিস করি। তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সুদূর ইতালি থেকে এদেশে আসা হয়েছে। এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা মানবতা, দেশ ও অগ্রযাত্রার দুশমন। এই দুশমনদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। হর্লি আর্টিজানের কর্মচারী নিহত জাকির হোসেন শাওনের মা মাসুদা বেগম আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, আমার ছেলে হলি আর্টিজানে কাজ করতো। ঘটনার দিন রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে পুলিশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। তিনি আরো বলেন, তিনদিন পর শাওন মারা যায়। তার মৃত্যুর পর আমরা কারও বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারিনি। বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মো. মুখলেসুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল অস্থায়ী বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এসময় মো. মুখলেসুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার দিন পুলিশ জীবন বাজি রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। সেইদিন পুলিশের দুইজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো অনেকেই। তিনি আরো বলেন, জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালাচ্ছে। জঙ্গিবাদের ব্যাপারে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশের একক সমস্যা নয়। এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের প্রত্যেকটি শান্তিকামী মানুষকে এই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এসময় ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বলেন, হলি আর্টিজানের ঘটনা বাংলাদেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশের বিষয়ে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। যা দেশের অগ্রগতির জন্য একটা বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তিনি আরো বলেন, ধর্মের নামে মানুষ হত্যা এটা কখনই কাম্য হতে পারে না। যারা এটা করেছে তারা অধর্মের কাজ করেছে। কারণ ধর্মে কোথাও নিরীহ মানুষ হত্যার কথা বলা হয়নি। ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ রুখতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে। জাতিকে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এখন যারা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে তারা ইংলিশ মিডিয়ামসহ ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করা শিক্ষার্থী। আমরা শুনেছি যে, আগে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে জড়াতো। এখন দেখা যাচ্ছে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাও জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। এটা জাতির জন্য বড় একটা হুমকির বিষয়। তিনি বলেন, আমাদের যে কাজটি করা দরকার তা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। সঠিক শিক্ষা না পাওয়ার কারণে অনেকেই জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। তাই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করতে হবে। এই উদ্যোগ সরকারকে গ্রহণ করতে হবে জরুরিভাবে। সংস্কৃতিকর্মী শমী কায়সার বলেন, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। নানা ধর্মের লোকজন হাজার বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। হলি আর্টিজানের ঘটনা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। জঙ্গিবাদ রুখতে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সংস্কৃতির আন্দোলনকে বেগমান করতে হবে। তৌহিদ রেজা নূর বলেন, ৩০ লাখ শহীদের বাংলাদেশে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদকে কখনই মেনে নেয়া যায় না।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, হলি আর্টিজানে যে জঙ্গি হামলা ঘটেছিল এটা মূলত বাংলাদেশের ললাটে একটা কলঙ্কজনক কালিমা লেপন করা হয়েছিল। যে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে এদেশে এমন বর্বরতা কখনই কাম্য হতে পারে না। এটা আমাদের সবাইকে রুখে দিতে হবে। হলি আর্টিজানে নিহত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসি রবিউল ইসলামের সহকর্মীরাও ফুল দিতে এসেছিলেন। এসময় ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের এসি তৌফিক উদ্দিন বলেন, রবিউল ইসলাম ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক অফিসার। তিনি পুলিশের সেবাকে সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে কাজ করে গেছেন। তিনি নিজ এলাকায় সামাজিক কাজও করতেন। একাধিক স্কুল প্রতিষ্ঠানও গড়েছেন। তার আদর্শে আমরা উজ্জীবিত হয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে আজীবন কাজ করে যাবো।