প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে দেশের প্রধান একটি দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতার গেঞ্জি পরা এবং হাতে ব্যান্ডেজসহ ছবি ছাপা হয়েছে। দু-একটি কাগজে হামলাকারীদের কয়েকজনের লাঠিসোঁটাসহ তাঁর গাড়িবহরের দিকে তেড়ে যাওয়ার ছবিও ছাপা হয়েছে। ইত্তেফাক-এর বর্ণনায় হামলায় নেতৃত্বদানকারীর পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে, রাস্তা অবরোধ করে বিএনপির নেতাদের গাড়ি আটকে হামলা চালানো হয়। তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও হামলাকারীদের উৎসাহে ঘাটতি দেখা যায়নি। বিএনপির নেতারা গাড়ি ঘুরিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটি মসজিদ এবং সংলগ্ন মাদ্রাসায় আশ্রয় নেওয়ার পর পুলিশ তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।
বিএনপির নেতারা এরপর চট্টগ্রাম ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘটনার জন্য ক্ষমতাসীন দলকেই দায়ী করেছেন। মির্জা ফখরুল স্থানীয় সাংসদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘ওই এলাকার এমপি আওয়ামী লীগের বড় পদে আছেন। তাঁর ইন্ধন আছে কি না সেটা আপনারা তদন্ত করে দেখবেন।’
মির্জা ফখরুলের ওপর হামলা হয়েছে যে রাঙ্গুনিয়ায়, সেই এলাকার বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ ঘটনাটিকে রহস্যজনক অভিহিত করে বলেছেন, ‘বিষয়টিকে নাটক মনে হচ্ছে।’ তাঁর দাবি, বিএনপির নেতাদের গাড়িবহর দুজন পথচারীকে ধাক্কা দেওয়ায় উত্তেজিত লোকজন কিছু একটা করেছে। ‘ঠাকুর ঘরে কে রে’, জিজ্ঞাসার আগেই তাঁর ‘আমি কলা খাইনি’ ব্যাখ্যাটি নিয়ে কোনো মন্তব্যের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
গত মঙ্গলবার, ১৩ জুন রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো ভূমিধসের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাটি ঘটেছে রাঙামাটিতে। সেখানে প্রাণহানি হয়েছে ১১৮ জনের। পাহাড়ধসের দিনে প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন এবং স্টকহোমে তিন দিনের সফরে রওনা হওয়ার কড়া সমালোচনা করেছেন বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া। তাঁর সমালোচনার ভাষাটি সবার পছন্দ হওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগেরও হয়নি। কিন্তু তার জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির নেতাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি। বিএনপি কেন রাঙামাটি যায়নি, সেই প্রশ্ন তিনি যেমন তুলেছেন, তেমনি গলা মিলিয়েছেন হাছান মাহমুদও। এর আগে সুনামগঞ্জের হাওরে বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের রেষারেষি এবং দোষারোপের রাজনীতি হয়েছে। বিএনপির নেতারা জবাব দিয়ে বলেছেন, হাওরে যেতে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়েছিল। আর আওয়ামী লীগের যে সুবিধা আছে, বিএনপির সেই সুযোগ থাকার কথা নয়।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হিসেবে সরকারি হেলিকপ্টারে সেখানে সফর করেছেন এবং সঙ্গে দলীয় একটি প্রতিনিধিদলকেও নিয়ে গিয়েছিলেন।
এখন বিএনপির মহাসচিব যখন সেখানে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন, তখন তাঁর যাত্রাভঙ্গের জন্য আওয়ামী লীগের অতি-উৎসাহী নেতা-কর্মীরা যে পথ বেছে নিয়েছেন, তা শুধু গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়, এতে রয়েছে একধরনের অশনিসংকেত। এ ধরনের হামলাই রাজনীতিকে হিংসা ও প্রতিহিংসার দুষ্টচক্রের পথে ঠেলে দেয়। আশঙ্কা হয়, অতীতে সাতক্ষীরায় শেখ হাসিনার গাড়িবহরে বিএনপির হামলা এবং নারায়ণগঞ্জ ও কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে আওয়ামী লীগের হামলার সেই হিংসার সংস্কৃতিই কি আবার ফিরতে শুরু করল?
ওবায়দুল কাদের মির্জা ফখরুলের ওপর হামলাকে নিন্দনীয় বলে অভিহিত করেছেন এবং এর তদন্ত হবে বলে ঘোষণা করেছেন। ওবায়দুল কাদের ঘটনার সরাসরি নিন্দা করতে কিছুটা কুণ্ঠিত ছিলেন বলেই ইঙ্গিত মেলে। দলের ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বিরুদ্ধে ইন্ধনের অভিযোগ ওঠায় তাঁর মধ্যে যদি কোনো কুণ্ঠা তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর তদন্তের প্রতিশ্রুতিতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যায় না। তাঁর বরং উচিত হবে যাঁদের নাম এসেছে তাঁদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিয়ে ফৌজদারি অপরাধের পুলিশি তদন্ত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া এবং দোষীদের বিচারের ব্যবস্থা করা।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার যে চেষ্টা হয়েছিল, তার তুলনায় মির্জা ফখরুলের ওপর হামলা তেমন গুরুতর নয় এমন কথাও কেউ বলতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা গুরুতর ও ভয়ঙ্কর অপরাধ ছিল। সেই হামলায় প্রশাসনের একটি অংশ জড়িত ছিল বলে বিষয়টির একটি আলাদা মাত্রা আছে। ওই ঘটনার চলমান বিচারপ্রক্রিয়ায় দোষী ব্যক্তিদের সাজা দিলে প্রমাণিত হবে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
মির্জা ফখরুলের ওপর হামলায় দুটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রথমত, সরকার বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেবে কি না? বিএনপির কাউন্সিলের পর গত দেড় বছরে ঢাকায় কোনো ধরনের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের অনুমতি না দেওয়া এবং দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ঠুনকো অজুহাতে তল্লাশি চালানোর মতো ঘটনায় সে রকম ইঙ্গিত লক্ষণীয়। মির্জা ফখরুলের ওপর হামলার নিন্দা জানাতে গিয়ে খালেদা জিয়া দাবি করেছেন, বিএনপি নির্বাচন করতে চায় বলেই তাঁকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এসব করা হচ্ছে। এ ধরনের হামলা খালেদা জিয়ার দাবির পক্ষেই সন্দেহ জোরদার করতে পারে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ক্ষমতাসীন দল গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিএনপির ন্যায্য ও স্বীকৃত অধিকারগুলো দেওয়ার পক্ষে থাকে, তাহলে সরকারের ভেতরে শক্তিশালী কোনো গোষ্ঠী কি তা নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে? তা না হলে যে ধরনের হামলা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার সাক্ষ্য বহন করে, সে রকম ঘটনা সরকার কেন সহ্য করবে? তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে রাঙ্গুনিয়ার ঘটনা প্রমাণ করে দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ওপর কেন্দ্রের যেমন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনি প্রশাসনও অকার্যকর?
দ্বিতীয় প্রশ্নটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এর ১৮ জুনের বাংলাদেশ বিষয়ক সম্পাদকীয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ‘পিপল ডিজার্ভ বেটার: বাংলাদেশ’স স্টেরাইল অ্যান্ড পয়জনাস পলিটিকস ডু ডিজসার্ভিস টু ইটস পিপল’ শিরোনামের এই সম্পাদকীয়তে পত্রিকাটি বলেছে, উভয় দলের রাজনীতিকেরা নিষ্ফলা রেষারেষিতে লিপ্ত থেকে দেশের মানুষের ক্ষতি করছেন। তাঁদের উচিত গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকারের দিকে নজর দেওয়া, শক্তিপ্রয়োগ এবং অসহিষ্ণুতা ত্যাগ করা এবং জনগণের চাহিদা পূরণে মনোযোগী হওয়া।
আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে সবক চাই না। সেটা মোটেও শোভনীয় নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলালে আমরা কি আর অন্যের মুখ বন্ধ রাখতে পারব?