লন্ডনে সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশি নিহত

Slider সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সারাবিশ্ব

70791_london

 

 

 

 

 

লন্ডন: একটি মসজিদের সামনে মুসলিমদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন এক বাংলাদেশি। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার নাম জানা যায়নি। রোববার রাতে তারাবির নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হতেই একদল মুসলিমের ওপর ভ্যান উঠিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের অন্তত একজন শ্বেতাঙ্গ। তাকে উপস্থিত মুসল্লিরা ধরে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করেছে। হামলায় আহত হন ৮ থেকে ১০ জন। তাদের মধ্যে আর কোনো বাংলাদেশি আছেন কিনা তা জানা যায়নি। লন্ডন পুলিশ এ ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা বলে উল্লেখ করেছে। একে মুসলিমদের ওপর হামলা উল্লেখ করে লন্ডন পুলিশ প্রধান স্থানীয় মুসলিমদের জন্য সুরক্ষা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হামলার কড়া নিন্দা জানিয়েছেন মুসলিম নেতারা। নিন্দা জানিয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে, বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন, লন্ডনের মেয়র সাদিক খান প্রমুখ। লন্ডনের অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফ ও স্কাই নিউজ এ খবর দিয়েছে।
সুলতান আহমেদ (৩৪) নামে স্থানীয় এক দাতব্য কর্মীকে উদ্ধৃত করে টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়েছে, তিনি নিহত বাংলাদেশিকে শনাক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, নিহত ব্যক্তি বাংলাদেশি একজন প্রবীণ ব্যক্তি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সুলতান আহমেদের এক চাচা। তিনি তাকে বলেছেন, হামলার সময় হামলাকারী ‘কিল অল মুসলিমস’ বলে চিৎকার করতে থাকে।
উল্লেখ্য, রোববার দিবাগত রাতে তারাবির নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বের হতেই প্রায় ১১ জন মুসল্লির ওপর বিশাল একটি ভ্যান উঠিয়ে দেয় ওই সন্ত্রাসী। তার নাম জানা যায়নি। হামলার পরই তাকে আটক করে মুসল্লিরা। তবে মসজিদের ইমাম সবাইকে শান্ত করে হামলাকারীকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করেন। এ ঘটনা ঘটে ফিন্সবারি পার্ক এলাকায় সেভেন সিস্টারস রোডে মুসলিম ওয়েলফেয়ার মসজিদের বাইরে।
সুলতান আহমেদ ঘটনার বর্ণনাতে বলেছেন, আমার আঙ্কেল সবেমাত্র মসজিদ থেকে বেরিয়েছেন। একপর্যায়ে প্রবীণ ওই বাংলাদেশি রাস্তায় পড়ে যান। মুসল্লিরা তখন তাকে সহায়তা করার জন্য দৌড়ে যান। এ সময়ই তাদের ওপর দিয়ে ভ্যান চালিয়ে দেয়া হয়। ভ্যানটি ওই প্রবীণ বাংলাদেশির ওপর দিয়ে চলে যায়। এতে আরো দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক জানা গেছে। সুলতান আহমেদ বলেন, আমার আঙ্কেল আমাকে বলেছেন, ভ্যানের চালক এ সময় চিৎকার করে বলতে থাকে ‘আই ওয়ান্ট টু কিল অল মুসলিমস’। অর্থাৎ আমি সব মুসলিমকে হত্যা করতে চাই। ভ্যানের ভিতর মোট তিনজন ছিল। তাদের দু’জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ধড়া পড়া একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার নাম, পরিচয় জানা যায়নি।
লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে হাসপাতালে। ঘটনাস্থলেই টিকিৎসা দেয়া হয়েছে আরো দু’জনকে। লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশকে এ বিষয়ে তদন্তে সহায়তা করছে সন্ত্রাস দমন বিষয়ক কমান্ড ইউনিট। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে ১১ জন মুসলিমের ওই দলের ওপর উঠিয়ে দেয়া হয়েছে ভ্যানটি। এটাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। সোমবার এ বিষয়ে জরুরি সভা করার কথা রয়েছে তার।
মুসলিম কাউন্সিল অব বৃটেনের (এমসিবি) সাধারণ সম্পাদক হারুণ খান বলেছেন, রাতের বেলা সাধারণ বৃটিশ নাগরিকরা তাদের বিভিন্ন কাজের জন্য বাইরে বের হন। মুসলিমরা নামাজ আদায় করার পর বাইরে ঘুরতে বের হন। কিন্তু যে ঘটনা ঘটেছে তাতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী মনে হচ্ছে, ইসলাম বিরোধিতা থেকে এ হামলা করা হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ও মাসে মুসলিমরা অনেক ইসলামবিরোধী ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটলো ফিন্সবারিতে। যেহেতু পবিত্র রমজান মাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, মুসলিমরা স্থানীয় মসজিদগুলোতে যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তারা ঈদ উদযাপন করবেন। তাই জরুরি ভিত্তিতে মসজিদগুলোর বাইরে আমরা নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।
বৃটেনের লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ক্রেসিডা ডিক স্থানীয় মুসলিম সমপ্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হামলাস্থলে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, এটি স্পষ্টভাবেই মুসলিমদের ওপর হামলা। তার ভাষ্য, ‘আমরা একে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে বিবেচনা করছি। স্থানীয় কম্যুনিটি ও দেশের মানুষের মতো আমরা পুলিশও এ ঘটনায় হতবাক। আমরা যেকোনো ধরনের বিদ্বেষসূচক অপরাধ ও সহিংস চরমপন্থাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেই। যেখানেই সম্ভব, আমরা এই হামলা ঠেকাই। যদি না পারি, তাহলে আমরা চেষ্টা করি অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে।
যে ভ্যানটি মুসল্লিদের ওপরে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে তার পিছনেই একটি মোটরসাইকেলে ছিলেন একজন ডেলিভারি ড্রাইভার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি স্কাই নিউজকে বলেছেন, অকস্মাৎ দেখি ভ্যানটি বাম দিকে মোড় ঘুরলো। তারপর তা উঠিয়ে দিলো সাধারণ মানুষের ওপর। তাদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিল গাড়ি। ভ্যানটি ছিল সাদা।
আবদুল্লাহ বলেন, আমি দেখতে পাই রাস্তার ওপর পড়ে আছেন ৬ বা ৭ জন মানুষ। তাদের বেশির ভাগই পুরুষ। তারাবি নামাজ শেষ হওয়ার ঠিক পর পর এ ঘটনা ঘটেছে। নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভ্যান নিয়ে সেখানে হাজির হয়। তারা যে রাস্তাটি ব্যবহার করেছে তা একটি ব্লকড রোড বা বন্ধ রাস্তা। আবদুল্লাহ বলেন, যে  দু’জন ওই ভ্যান থেকে পালিয়েছে তারা দূরে যেতে পারে নি। হয়তো ফিন্সবারি পার্ক এলাকাতেই কোথাও আছে।
যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার পশ্চাদদেশে রয়েছে ট্যাটু। সে অসুস্থ নয়। মদ্যপও নয়। তাকে ৫ থেকে ৬ জন পুলিশ কর্মকর্তার একটি দল গ্রেপ্তার করেছে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মার্কিন চরমপন্থা নজরদারি সংস্থাগুলো বলছে, এই হামলার পর মার্কিন শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিরা উল্লাশ প্রকাশ করেছে অনলাইনে। আবদুল্লাহর মতে, এটা একটি সন্ত্রাসী হামলা। ঘটনার পর পাশের একটি কফির দোকানে ছিলেন রাতিপ আলসুলেইমেন। তিনি এ অবস্থা দেখে দ্রুত ওই দোকান থেকে বের হয়ে পালান। আল সুলেইমেন বলেছেন, ঘটনার পর ৮ থেকে ১০ জন আহত ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী আবদি কাদের ওয়ারফা বলেছেন, আমি ওই ভ্যানের নিচে রক্তাক্ত একজনকে দেখতে পাই। তার শরীর থেকে রক্ত ছুটছে ফিনকি দিয়ে। তিনি কিছু বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমরা শুনতে পেলাম না। যাদের ওপর এভাবে ভ্যান উঠিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগই যুবক।
স্কাই নিউজ যেসব ভিডিও ইমেজ প্রচার করেছে তাতে দেখা যায়, অনেক মানুষ মাটিতে পড়ে আছেন। তাদের কাউকে কাউকে দেখে মনে হচ্ছিল মারাত্মক আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এ ঘটনা ঘটেছে ওয়াডকোট স্ট্রিটে প্রবেশ পথে। লন্ডন অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস বলেছে, তারা ঘটনাস্থলে বেশ কিছু ‘রিসোর্স’ পাঠিয়েছে। সেখানে মোতায়েন রয়েছে কয়েক ডজন পুলিশ, অগ্নি ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা বিষয়ক যানবাহন। উপস্থিত রয়েছেন সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা। মাথার ওপর দিয়ে টহল দিচ্ছে হেলিকপ্টার। মেট্রোপলিটন পুলিশ এক বিবৃতিতে ৪৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে এ ঘটনায় গ্রেপ্তারের কথা বলেছে। বলা হয়েছে, তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতাল ছাড়পত্র দিলে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হবে।
মুসলিমদের নিন্দা: লন্ডনে ফিন্সবারি পার্কের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন মুসলিম সম্প্রদায়। তারা একে ‘কাপুরুষোচিত হামলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে আহত সবার প্রতি জানিয়েছেন সমবেদনা। নিন্দা জানিয়েছেন বিরোধী লেবার নেতা জেরেমি করবিন, লন্ডনের মেয়র সাদিক খান। এ খবর দিয়েছে অনলাইন স্কাই নিউজ। উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে কথা বলে মুসলিমদের সংগঠন রমাদান ফাউন্ডেশন। এর সদস্য মোহাম্মদ শফিক বলেছেন, লন্ডনের ফিন্সবারি পার্কে মসজিদের বাইরে নামাজ আদায় করে বের হওয়া মুসল্লিদের ওপর ভ্যান উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাকে আমি কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অশুভ হামলা বলে মনে করি ও নিন্দা জানাই। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এটা ছিল নিরপরাধ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত হামলা। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, এটা নিশ্চিতভাবে ইচ্ছাকৃত সন্ত্রাসী হামলা। তাই এটাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখা উচিত। তিনি আরো বলেন, এই অশুভ সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের পাশে সব বৃটিশ মুসলিম সম্প্রদায় দাঁড়াবেন বলে আমি মনে করি। লন্ডনে কয়েক বছর ধরে ভয়াবহ আকারে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামবিরোধিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই হারে বেড়েছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ। প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে এ ঘটনাকে ‘ভয়াবহ ঘটনা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আহত সবার প্রতি ও তাদের প্রিয়জনের প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছেন তিনি। ঘটনাস্থলে জরুরি সেবাদানকারী সংস্থাগুলো রয়েছে বলে জানিয়েছেন তেরেসা। ঘটনার কড়া নিন্দা জানিয়েছেন বিরোধী লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিন। তিনি বলেছেন, ফিন্সবারি পার্কে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে আমি ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্ত। তিনি বলেছেন, মসজিদগুলো, পুলিশ ও ইলিংগটন কাউন্সিলের সঙ্গে আমি এ ঘটনায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। এতে যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি আমার সমবেদনা। নিন্দা জানিয়েছেন লন্ডনের মেয়র সাদিক খানও। তিনি বলেছেন, যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সবার প্রতি আমার সমবেদনা ও প্রার্থনা। আমাদের জরুরি বিভাগগুলোর তৎপরতায় আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, এ হামলা দৃশ্যত একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে করা হয়েছে, যেমনটা করা হয়েছে ম্যানচেস্টার, ওয়েস্টমিনস্টার ও লন্ডন ব্রিজে। এটা আমাদের সহিষ্ণুতা, স্বাধীনতা ও সম্মানবোধের অভিন্ন মূল্যবোধের ওপর আঘাত। এখনো ঘটনার মুখোশ উন্মোচন হয় নি। সাদিক খান বলেন, তাই আমি লন্ডনের অধিবাসীদের শান্ত ও চোখ খোলা রাখার আহ্বান জানাই। সন্দেহজনক কোনো কিছু দেখলেই আপনারা পুলিশকে জানান। ফিন্সবারি পার্ক মসজিদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ কোজবার টুইটে বলেছেন, ফিন্সবারি পার্ক এলাকায় মসজিদের বাইরে যে হামলা হয়েছে তা কাপুরুষোচিত। হতাহতদের প্রতি আমাদের সমবেদনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *