ড. আকবর আলি খান : আমি মনে করি আমরা অর্থনীতিবিদেরা একটা খুব খারাপ কাজ করেছি। সুশাসনের বিষয়টিকে আমরা একটি অর্থনৈতিক প্রশ্ন হিসাবে চিহ্নিত করেছি। বলা হচ্ছে যে অর্থনীতির জন্য সুশাসন প্রয়োজন। আসলে এটাতো অত্যন্ত গৌন বিষয়। সুশাসন প্রয়োজন মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য। সুশাসন প্রয়োজন আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য। কাজেই এই যে প্রয়োজনটা এটাকে ভুলে গিয়ে আমরা অর্থনীতির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে, অর্থনীতির মুক্তির পথ বের করতে হবে।
আমাদের অর্থনীতির একটি বড় সমস্যা হলো, এখানে অনিশ্চয়তার মাত্রা বেশি। এ অনিশ্চয়তার মাত্রা বেশি হওয়ার কারণ দুটি। একটি হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। কয়েকদিন পর পর যখনই দেখা যায়, সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে তখনই পরবর্তী সরকার পুরনো সরকারের যে দায়দায়িত্ব ও নীতিমালা, সেগুলো গ্রহণ করতে চায় না এবং তা পরিবর্তন করতে চায়। যখন বিনিয়োগকারীরাও জানেন, এই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে তখন তারা দীর্ঘমেয়াদি কোনো বিনিয়োগ করতে চান না। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত সর্বদলীয় মতৈক্য অনেক বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে এটিকে বলে বাইপার্টিসান পলিসি (Bipartisan policy)। এ ধরনের ব্যবস্থা না থাকলে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হন। আরেকটি সমস্যা হলো, সরকারও কখনো একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে না। যদি রাজনৈতিক পরিবর্তন নাও হয়, একই সরকার একই বিষয়ে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে থাকে। যখন যে রকম সুবিধা হয়, তখন সেভাবে দেখতে থাকে। এখন সরকার স্বল্পমেয়াদ অথবা দীর্ঘমেয়াদ লাভের কথা চিন্তা করতে পারে। স্বল্পমেয়াদে বিবেচনা করলে যখন যেভাবে সুবিধা হয়, তখন সে রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ পড়ে থাকে। কিন্তু যদি আপনি দীর্ঘমেয়াদের দিক থেকে দেখেন, তাহলে এই সল্পমেয়াদি লাভের কথা চিন্তা না করে আপনি যদি একই নীতি দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করেন এবং ওই নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করেন, তাহলে অর্থনীতির ওপর আস্থা অনেক বেড়ে যাবে।
সুতরাং আমাদের দেশে একটি বড় সংকট হলো আস্থার সংকট। ওই আস্থা না থাকার ফলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। বাজেট সম্পর্কে এটি ঠিক, সরকারের যে নীতির অস্থিরতা তা বাজেট প্রণয়নে অনেক সময়ে প্রতিফলিত হয়। বর্তমানে রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য দেখা যায়, অনেক স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই রকম ব্যবস্থা যদি নেওয়া হয়, তাহলে যারা বিনিয়োগকারী তারা বুঝতে পারেন না, সরকার শেষ পর্যন্ত কী করবে। যদি কাস্টমস ডিউটি বা বৈদেশিক শুল্কের বিষয়টি ধরেন এবং সেখানে যদি সরকারের বিঘোষিত নীতি হয়, তারা শুল্কের হার কমিয়ে আনবে ও প্রতিরক্ষণ হ্রাস করবে তাহলে তা অনেকটা সময় একইভাবে চালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, এক বছরের বাজেটে সরকার হঠাৎ করে শুল্ক কমিয়ে দিল, পরের বছর রাজস্ব আয়ের জন্য আবার হঠাৎ করে শুল্ক বাড়িয়ে দিলÑ এ ধরনের যে পরিবর্তন, তা মোটেও অভিপ্রেত নয়। আর বাজেট ব্যবস্থাগুলোর আরেকটি বড় সমস্যা আছে। তা হলো, আমাদের এখানে যারা বিনিয়োগকারী আছেন তাদেরও ব্যবসাবান্ধব যে বাজেট, তা সম্পর্কে ধারণাটি তাদের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক নয়। অনেক ব্যবসায়ীই বিভিন্ন সুযোগ চেয়ে থাকেন বাজেটে। তবে এর যে ফল কী, তা তারা যথেষ্ট ওকিবহাল নন। যেমন ধরুন, আপনি যদি ট্যাক্স হলিডে বাড়িয়ে দেন তাহলে যারা নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করবেন, তারা উৎসাহিত হবেন। যারা পুরনো শিল্পে আছেন, কর অবকাশ দিয়ে যে গড় ক্ষতি হবে তা তাদের থেকে কর আদায় করে পোষানো হবে। এক্ষত্রে দেখা যাবে, যারা ট্যাক্স হলিডে পায়নি তাদের বাস্তবিকপক্ষে কর বেশি দিতে হবে। এখন বিনিয়োগবান্ধব কর ব্যবস্থা হলো সেই ব্যবস্থা যেটি সামগ্রিকভাবে করের হার হ্রাস করে। আমাদের ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থগোষ্ঠীর জন্য যে ব্যবস্থা, তা তারা চান। সামগ্রিকভাবে কর হ্রাস নিয়ে চিন্তিত নন। যেমন অনেক সময় ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, সুদের হার কমানো হোক। এখন দেশে যদি মূল্যস্ফীতির হার বেশি থাকে, তাহলে প্রকৃত সুদের হার বাড়াতে হবে এবং তা বাড়ালে সুদের হার বেশি হবে। এক্ষেত্রে যদি ব্যাংকগুলোকে কম সুদে ঋণ দিতে বাধ্য করা হয় এবং তাদের ক্ষতি হয়, তাহলে তারা ঋণের প্রবাহ কমিয়ে দেবে। ফলে যা হবে যারা ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে ইতোমধ্যেই ঋণ নিয়েছে। তারা কম সুদ দিতে পেরে লাভবান হবে। কিন্তু যারা নতুন ঋণ নিতে চান, তারা ঋণের সুযোগ পাবেন না। কারণ ব্যাংকগুলো আর্থিক লোকসান দিয়ে ঋণ দিতে চাইবে না। এ অবস্থায় আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর ওপর জোর না দিয়ে দিতে হবে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে অর্থনীতির ওপর একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাজেটে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর স্বার্থে নেওয়া হয়, সামগ্রিক বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
অন্যদিকে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে পেশাজীবীদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় গুণ থাকা প্রয়োজন, তা হলো তাদের পেশাগত দক্ষতা। পেশাগত দক্ষতা যদি তাদের থাকে এবং যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তারা সমাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন। এ জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যা করা হয়েছে, তা হলো পেশাজীবীদের পেশাগত দক্ষতা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের সংগঠনের ওপর দেওয়া হয়েছে। যেমনÑ ডাক্তারদের সংগঠন ডাক্তারদের পেশাগত দক্ষতা নিয়ন্ত্রণ করে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টদের সংগঠন তাদের পেশাগত দক্ষতা নিয়ন্ত্রণ করে। ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষতা ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশে আমরা মোটামুটিভাবে ওই মডেলই অনুসরণ করছি। আমাদের অনেক পেশাজীবী সংগঠন সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো পেশাগত সংগঠন তাদের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে পারছে না। একটি পেশাগত সংগঠন যার সম্পর্কে প্রায়ই বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যায়। যেমন বাংলাদেশে যারা আইনজীবী আছেন, তারা অনেকেই সঠিকভাবে কাজ করেন না। সঠিকভাবে কাজ না করলে পেশাগত দিক থেকে ব্যবস্থাও গৃহীত হয় না। কারণ ওই সংগঠন তাদের দ্বারা নির্বাচিত। কাজেই নির্বাচিত সংগঠন তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। এ নিয়ে সাবেক অনেক বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা মনে করেন, এ দায়িত্ব বিচারপতিদের হাতে ন্যস্ত করা উচিত। পাকিস্তান আমলে লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যাক্টে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিচারকদের দেওয়া হয়েছিল। তারপর আইয়ুব খানের আমলে বার কাউন্সিল অ্যাক্ট করে লিগাল প্র্যাকটিশনার্সদের ওপর বিচারকদের ক্ষমতা খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। সাবেক অনেক বিচারককেই দুঃখ প্রকাশ করতে দেখেছি, এ ব্যবস্থাটি দেশের বিচারব্যবস্থার জন্য ভালো হয়নি।
সারা পৃথিবীতে এখন যেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে, সেটি হলো যারা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, যারা অ্যাকাউন্টিং ও অডিট প্রফেশনে আছেন- ওই অডিট প্রফেশনকে কী করে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এ ব্যপারে তাদের প্রতিষ্ঠানের ওপরই দায়িত্ব দেওয়া ছিল। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যে বড় বড় কেলেঙ্কারি হয়, সেসব কেলেঙ্কারির ফলে সারবেনস অক্সলি অ্যাক্টের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয় নিরীক্ষার পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। গত দশকের অভিজ্ঞতা থেকে যা দেখা যাচ্ছে, এতে হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থার খুব বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। বর্তমানে বিশ্বে চারটি বড় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। গত দশ বছরের যেসব কেলেঙ্কারি আর্থিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এতে দেখা যায়- প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই কোনো না কোনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে যা হয়েছে, তা হলো সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ফলে নিরীক্ষার ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে গেছে। তাই ব্যবসার জগতে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা সারা বিশ্বে এর কোনো সঠিক সমাধান পাইনি। বাংলাদেশে এখন বিতর্ক চলছে, বাংলাদেশে এই হিসাব নিরীক্ষকদের কি সরকার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া হবে, না ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের কাছে থাকবে? এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বারবার বলা হচ্ছে, তারা একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান করবে। তবে বাংলাদেশের ব্যাপারে আমার মনে হয়, আমাদের যে ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট- তা অত্যন্ত দুর্বল। বাংলাদেশের হিসাবরক্ষণ করার জন্য যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর অনেক দুর্বলতা রয়েছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ যার হাতেই থাকে- প্রতিটি পেশায়ই পেশাগত দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। এগুলো একদিনে করা সম্ভব হবে না। এগুলো পেশাজীবীদের নিজেদের, সংসদ ও সরকার এই তিন দিক থেকে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত পর্যালোচনা করা দরকার।
স্বার্থের সংঘাত প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হলো- কোনো সাধারণ সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়, কোনো সিলভার বুলেট নেই। মনে রাখা দরকার, তা হলো Eternal vigilance is the price of freedom. এগুলো সব সময়, প্রতিনিয়ত পরিবীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সমাজেরও করতে হবে, পেশাজীবীদের নিজেদেরও করতে হবে। আত্মজিজ্ঞাসা থাকতে হবে। এগুলো যদি আমরা ছেড়ে দিই, তাহলে দেখা যাবে- যে কোনো জায়গার ব্যর্থতা পুরো অর্থনীতির ওপর পড়বে, গোটা সমাজব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করবে। কারণ যতবেশি কারিগরি পরিবর্তন হচ্ছে, ততই পেশাজীবীদের ভূমিকা আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
লেখক : কলামনিস্ট, গবেষক
-আমাদেরসময়