টুর্নামেন্ট শুরু হতে তখনো এক মাসেরও বেশি বাকি। প্রশ্নটা শুনে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা একটু হেসে বলেছিলেন, ‘মনে বড় একটা চিন্তাই আছে। কারণ চিন্তা বড় করলে না বড় কিছু পাবেন।’ তারপর দার্শনিকের ভঙ্গিতে এমন একটা কথা বলেছিলেন, যেটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে বিশেষ ম্যাগাজিনে মাশরাফির সাক্ষাৎকারের শিরোনাম হয়েছিল। ‘কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’
কোনো কিছুই যেহেতু অসম্ভব নয়, ‘গ্রুপ অব ডেথ’ থেকে সেমিফাইনালে ওঠাই বা তা হবে কেন? ‘গ্রুপ অব ডেথ’-ই তো! গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। তিনটিই বাংলাদেশের চেয়ে র্যাঙ্কিংয়ে ওপরে। মাশরাফির মনে যত ‘বড় চিন্তা’ই থাক, এই গ্রুপ থেকে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে যাবে, এটা একটু আকাশকুসুম কল্পনাই ছিল। অথচ সেটিই এখন ঘোরতর বাস্তব এবং ‘কোনো কিছুই অসম্ভব নয়’ মনে করা মাশরাফিও যাতে একটু হকচকিয়ে গেছেন!
এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের কাছে অস্ট্রেলিয়ার পরাজয়ে বাংলাদেশের সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর মাশরাফির প্রতিক্রিয়ায় প্রথমে তাই একটি মাত্র শব্দই থাকল—‘অবিশ্বাস্য!’ বিকেলের দিকে একটা কাজে হোটেলের বাইরে গিয়েছিলেন। একটু পরপরই চোখ চলে যাচ্ছিল মোবাইলের পর্দায়। ক্রিকইনফোতে খবর রাখছিলেন খেলার। অস্ট্রেলিয়ার হেরে যাওয়ার খবরটা সেখান থেকেই পেলেন। যা তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল আনন্দের বন্যায়। উচ্ছ্বাস ফুটে বেরোল কথাতেও, ‘এই গ্রুপ থেকে আমরা সেমিফাইনাল খেলছি, এটা ভাবতে কী যে ভালো লাগছে!’
যেটির বৃহত্তর একটা তাৎপর্যও দেখছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, ‘এই ধরনের টুর্নামেন্টগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য খুব আদর্শ। এখন অন্তত ১৫ তারিখ পর্যন্ত সবাই আমাদের সম্মানের চোখে দেখবে।’
কাল যেখানে অস্ট্রেলিয়ার আশার সমাধি হলো, আগামী ১৫ জুন বার্মিংহামের সেই এজবাস্টন মাঠেই বাংলাদেশের সেমিফাইনাল। প্রতিপক্ষ এখনো অজানা। ‘এ’ গ্রুপের খেলা শেষ। ইংল্যান্ড আর বাংলাদেশ উঠে গেছে সেমিফাইনালে। ‘বি’ গ্রুপ থেকে কোন দুই দল, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে আজ ও আগামীকালের ম্যাচে।
আইসিসির স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। গ্রুপ পর্বের শেষ চারটি ম্যাচই পরিণত হয়েছে নকআউটে। ‘বি’ গ্রুপে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা তো আক্ষরিক অর্থেই ‘কোয়ার্টার ফাইনাল’। এমনই মজার টুর্নামেন্ট যে সেমিফাইনাল নিয়ে ইংল্যান্ড বা বাংলাদেশের হোমওয়ার্ক করার কোনো উপায় নেই। চার দলের যেকোনোটির বিপক্ষেই যে খেলতে হতে পারে!
ইংল্যান্ড তিন ম্যাচেই জিতে সেমিফাইনালে উঠেছে। বাংলাদেশের মাত্র একটিই জয়। তবে সেই জয় বিশ্ব ক্রিকেটে এমনই এক আলোড়ন যে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে উঠে যাওয়াটাকে শুধুই ভাগ্যের বদান্যতা বলার আগে সবাই দুবার ভাবছে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জীবন-মরণ ম্যাচে বাংলাদেশ যে খেলাটা খেলেছে, কাল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া তা খেলতে পারলে তো গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় না।
হ্যাঁ, ভাগ্যের ছোঁয়া তো একটু পেয়েছেই বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বৃষ্টির কল্যাণে পাওয়া ১ পয়েন্টেই তো খুলে গেছে সেমিফাইনালের দুয়ার। যা মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৯২ বিশ্বকাপের পাকিস্তানের কথা। এখন পর্যন্ত যেটির সঙ্গে এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির বাংলাদেশের আশ্চর্য মিল। সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৪ রানে অলআউট হয়ে গিয়েও বৃষ্টির বদান্যতায় ১ পয়েন্ট পেয়েছিল পাকিস্তান। শেষ পর্যন্ত সেটিই তাদের নিয়ে যায় সেমিফাইনালে। মিলটা এখানেই শেষ নয়। এখানে বাংলাদেশের মতো সেবার পাকিস্তানের সেমিফাইনালে ওঠাও নিজেদের হাতে ছিল না। চেয়ে থাকতে হয়েছিল অন্য দুই দলের খেলার দিকে। অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ, যাতে জিতলে পাকিস্তানের বদলে সেমিফাইনালে চলে যেত ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অস্ট্রেলিয়া আগেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেওয়ায় পাকিস্তানের একটু ভয়ও ছিল, বোর্ডারের দল না একটু গা ছাড়া দেয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অস্ট্রেলিয়াই জেতে।
ওই ম্যাচটা হয়েছিল মেলবোর্নে। পাকিস্তান দল সেদিন ক্রাইস্টচার্চে অপেক্ষায়। দেশে ফেরত যেতে হবে, না সেমিফাইনাল খেলতে অকল্যান্ড। ক্রাইস্টচার্চের হোটেলে ইমরান খান দলের সব খেলোয়াড়কে নিয়ে একসঙ্গে অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ দেখেছিলেন টিভিতে। কার্ডিফে এমন কোনো গল্প নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা সারা দিন যে যার মতো ঘুরে বেড়ালেন। নিজের হোটেল রুমেই বন্দী থাকলেন অনেকে। যে চ্যানেলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি দেখা যাচ্ছে, হোটেলে তা নেই। বাংলাদেশ দলের মিটিং রুমের টিভিতে বিশেষ ব্যবস্থায় ওই চ্যানেলটা আনা হয়েছিল, তবে সেখানে বসে নিরবচ্ছিন্ন কেউই খেলা দেখেননি।
এজবাস্টনের খবর অবশ্য সবাই রাখছিলেন। লাগেজ-টাগেজ গোছানোর কাজও চলছিল। বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠুক না উঠুক, পরদিন বার্মিংহাম যাওয়া নিশ্চিত হয়েছিল আগেই। পার্থক্য বলতে সেমিফাইনালে উঠলে বার্মিংহামে গিয়ে থাকবে দল। না উঠলে দেশে ফেরার বিমানে চড়বে। বাংলাদেশের ফিরতি ফ্লাইট যে বার্মিংহাম থেকেই।
এই দেখুন, ১৯৯২ বিশ্বকাপের পাকিস্তানের সঙ্গে আরেকটি মিল। সেমিফাইনালে উঠুক না উঠুক, পরদিন পাকিস্তান দলকেও অকল্যান্ডে যেতেই হতো। হয় সেমিফাইনাল খেলতে, নয়তো দেশে ফিরতি ফ্লাইট ধরতে।
এত যখন মিল, মাশরাফির বাংলাদেশ কি শেষটাও মিলিয়ে দেবে ইমরানের পাকিস্তানের সঙ্গে! সেই বিশ্বকাপে কী হয়েছিল, আপনি জানেন নিশ্চয়ই।