ঢাকা: অসাধারণ এক জয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলার আশা বাঁচিয়ে রাখলো বাংলাদেশ। কার্ডিফে সাকিব-মাহমুদুল্লাহ যে খেলা দেখালেন তা অবাক বিস্ময়ে দেখলো ক্রিকেট বিশ্ব। স্মরণশক্তি না হারানো পর্যন্ত এ খেলা স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেও অনেক অনেক দিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এ জয়। ১৬ বল হাতে রেখে ২৬৫ রান টপকে যায় বাংলাদেশ। হাতে তখনো পাঁচ উইকেট। ২০০৫ সালে এ মাঠেই বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয় পায়। এবার আরেকটি স্মরণীয় জয় এলো এ মাঠেই। আজ অস্ট্রেলিয়া যদি ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যায় তবে বাংলাদেশ স্বপ্নের সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। আর অস্ট্রেলিয়া জিতলে তারাই যাবে সেমিফাইনালে। সেক্ষেত্রে অসাধারণ এ জয়টিই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি হয়ে থাকবে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের এটি দশম ওয়ানডে জয়। এ জয়ের আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে ফের ছয় নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
শুরুটা এক হতাশার। ৩৩ রানে শীর্ষ চার ব্যাটসম্যান নেই। লক্ষ্য ২৬৫। বাংলাদেশের সমর্থক জুড়ে হতাশার ছায়া। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে বিদায়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে নির্লজ্জ হারের শঙ্কা। এমন অবস্থা থেকে অসাধারণ এক রেকর্ডগড়া জয়। সাকিব আল হাসান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ডাবল সেঞ্চুরির পার্টনারশিপ আর দুজনের ব্যাক্তিগত সেঞ্চুরি। ক্রিকেট বিশ্বের সব পন্ডিত বিশ্লেষকরা অবাক। নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের দেশের বাইরে কোন জয় ছিল না। এই সেদিন পর্যন্ত। কিন্তু দিন যে বদলে গেছে। মে মাসেই আয়ারল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারায় বাংলাদেশ। এরপর মাস না পেরোতেই ফের জয়। এবার পূর্ণ শক্তির নিউজিল্যান্ড। নতুন ভেন্যু, বাঁচা মরার লড়াই। অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকা নিউজিল্যান্ড প্রথম ১০ ওভারে নিশ্চিত জয়ের স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছিলো। কিন্তু এরপর সাকিব আল হাসান আর মাহমুদুল্লাহর ধীর অথচ দৃঢ় প্রতিরোধ পাল্টে দেয় সব। ম্যাচসেরা হন সাকিব আল হাসান।
পঞ্চম উইকেটে ২২৪ রানের জুটি গড়েন সাকিব-তামিম। এটি ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটি। সাকিব ১১৫ বলে ১১৪ রান করে আউট হন। চাইলে আরো থাকতে পারতেন তিনি। কিন্তু মারমুখি হয়ে বোল্টের বোল্ড হন সাকিব। এটি তার সপ্তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। ১১ চার আর একটি ছক্কা ছিল তার ইনিংসে। ৯৫ রান থেকে বোল্টের বলে ছক্কা হাঁকিয়ে তিন অঙ্কের কোঠা পেরোন সাকিব। মাহমুদুল্লাহ ১০৭ বলে ১০২ রানে অপরাজিত থাকেন। এটি তার তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি। আগের দুটি করেছিলেন ২০১৫তে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে।
২৬৬ রানের মামুলি টার্গেট সামনে নিয়ে শুরুতেই বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। ইনিংসের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই ফেরেন তামিম ইকবাল। এরপর তৃতীয় বলে ফেরেন সাব্বির রহমান। তামিম শূন্য রানে ফেরার পর সাব্বির ফেরেন ৮ রানে। এরপর ব্যক্তিগত ৩ রানে ফেরেন সৌম্য সরকার। তিন উইকেটই নেন কিউই পেসার টিম সাউদি। মাত্র ১২ রান যোগ করতেই তিন উইকেট হারায় বাংলাদেশ। চতুর্থ উইকেটে মুশফিক-সাকিব যখন ছিলেন তখনও বাংলাদেশের অনেকেই আশাবাদি ছিলেন। কিন্তু দলের ৩৩ রানের মাথায় অ্যাডাম মিলনের বলে সরাসরি বোল্ড হয়ে গেলেন মুশফিক। ৩০তম জন্মদিনে মুশফিক করেন ১৪ রান। ২০১১ সালের পর এই প্রথম এত কম রানে বাংলাদেশ প্রথম চার উইকেট হারায়।
টসে জিতে ব্যাট করতে নামা নিউজিল্যান্ডকে মাত্র ২৬৫ রানে আটকে দেয় বাংলাদেশের বোলাররা। নিউজিল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ৬৩ রান করেন রস টেইলর। এছাড়া কেইন উইলিয়ামসন ৫৭ ও নেইল ব্রুম করেন ৩৬ রান। বাংলাদেশের হয়ে তাসকিন আহমেদ ২ ও মোসাদ্দেক হোসেন ৩ উইকেট নিয়েছেন। এ আসরে এটি তাসকিনের প্রথম ম্যাচ এটি। আর মোসাদ্দেক প্রথম ম্যাচে খেললেও দ্বিতীয় ম্যাচে খেলতে পারেন নি।
বোলিংয়ে নায়ক মোসাদ্দেক-তাসকিন
ক্রিজে বল হাতে ঝড় তুললেন তাসকিন আহমেদ। আর মোসাদ্দেক হোসেন দেখালেন স্পিন ভেলকি। আর ব্যাট হাতে ইনিংসের শেষটায় মলিন দেখালো কিউইদের। আগের ম্যাচে উভয়েই ছিলেন একাদশের বাইরে। তবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে সুযোগ নিয়ে বল হাতে চমক দেখালেন দুজনেই। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গতকাল নিউজিল্যান্ডকে ২৬৫ রানে আটকে দেয় বাংলাদেশ। আর বল হাতে মাত্র তিন ওভারের স্পেলে ১৩ রানে তিন উইকেট নেন অফস্পিনার মোসাদ্দেক হোসেন। গতকাল চার পেসার নিয়ে খেলতে নামে বাংলাদেশ। অফস্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজকে বাইরে রেখে একাদশে সুযোগ দেয়া হয় ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদকে। আর আস্থার প্রতিদান দেন তাসকিনও। বল হাতে বাংলাদেশকে প্রথম ব্রেক-থ্রো এনে দেন তাসকিন। পরে তাসকিন সাজঘরে ফেরান টাইগারদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠা ব্যাটসম্যান রস টেইলরকে। ৩৮.৩ ওভার শেষে ২০১/৩ স্কোর নিয়ে বড় সংগ্রহের পথে ছিল কিউইরা। তবে ব্যক্তিগত ৬৩ রানে রস টেইলরকে সাজঘরে ফেরান তাসকিন। এতে ইনিংসের শেষের দিকে ব্যাট হাতে গতি হারায় কিউইরা।
ইনিংসের শেষ ১০ ওভারে নিউজিল্যান্ডের স্কোর বোর্ডে যোগ হয় মাত্রই ৬২ রান। চলতি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ইনিংসের শেষ ১০ ওভারে সর্বনিম্ন রানের রেকর্ড এটি। আসরে এমন আগের রেকর্ডে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ১০ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ৬৩ রান।
গতকাল কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেন মাঠে টস জিতে ব্যাটিং বেছে নেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। বাংলাদেশ দলে সুযোগ নেন মোসাদ্দেক হোসেন ও তাসকিন আহমেদ। একাদশের বাইরে রাখা হয় অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ ও টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েসকে। বৃষ্টির কারণে কার্ডিফে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ শুরু হয় ১ ঘণ্টা দেরিতে। তবে ম্যাচের পরিসর থাকে অপরিবর্তিত। আর শুরুতে ৪৬ রানের জুটি গড়েন নিউজিল্যান্ডের দুই ওপেনার লুক রনকি ও মার্টিন গাপটিল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিস্ফোরক অর্ধশতক হাঁকানো কিউই ওপেনার লুক রনকির উইকেট তুলে নেন তাসকিন। ৭.১তম ওভারে তাসকিনের ডেলিভারিতে রনকির ক্যাচ তালুবন্দি করেন বাংলাদেশের অপর পেসার মোস্তাফিজুর রহমান।
আর অপর ওপেনার মার্টিন গাপটিলকে সাজঘরে ফেরান রুবেল হোসেন। ১২.৫তম ওভারে দলীয় ৬৯ রানে গাপটিলকে এলবিডাব্লিউর ফাঁদে ফেলেন এ টাইগার পেসার। চলতি আসরে তিন ম্যাচে গাপটিলের সংগ্রহ ২৬, ২৭ ও ৩৩। গতকাল ১৮.১তম ওভারে পেসার মোস্তাফিজুর রহমানকে চার হাঁকিয়ে দলীয় ১০০ রান পূর্ণ করেন কেন উইলিয়ামসন। ১৯ ওভার শেষে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১০৫/২-এ। পরে রানআউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন।
৩৮ ওভার শেষে দলীয় ২০০ রানের কোঠায় পৌঁছে নিউজিল্যান্ড।
পরে ভেলকি দেখান মোসাদ্দেক। ৪৪তম ওভারে বল হাতে জোড়া আঘাত হানেন মোসাদ্দেক হোসেন। ব্যক্তিগত ৩৬ রানে তিনি সাজঘরে ফেরান কিউই ব্যাটসম্যান নেইল ব্রুমকে। আর মোসাদ্দেকের স্পিনের বিপক্ষে কিউই ব্যাটসম্যান কোরি অ্যান্ডারসন মারেন ‘গোল্ডেন ডাক’। এতে ৪৪ ওভার শেষে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৩১/৬-এ।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ‘এ’ গ্রুপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচ হার দেখে বাংলাদেশ। তবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বৃষ্টিতে প- ম্যাচে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে টাইগাররা। একই চিত্র কিউইদেরও। ইংল্যান্ডের কাছে হার দেখে তারা। আর বৃষ্টিতে প- ম্যাচে তারা পয়েন্ট ভাগাভাগি করে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। ভিন দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ ১৬ হারের বিপরীতে জয় দেখেছে একবারই। তবে বাংলাদেশের এমন জয়টি দু’দলের সর্বশেষ সাক্ষাতে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রাক্কালে আয়ারল্যান্ডে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে নিউজিল্যান্ডের দেয়া ২৭১ রানের টার্গেটে পাঁচ উইকেটের সাবলীল জয় কুড়ায় বাংলাদেশ।