ঢাকা: চলতি অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের নানা অসংগতি ও অর্থমন্ত্রীর নেতিবাচক ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। অন্যদিকে বাজেটের ভূয়সী প্রশংসা করেছে সরকারি দলের এমপিরা। গতকাল সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, বাজেটে আশা করেছিলাম হাওর এলাকা নিয়ে অর্থমন্ত্রী বেশেষ কোনো পরিকল্পনা বা বরাদ্দ দেবেনে। কিন্তু তা করা হয়নি। ফসল হারানো হাওরের মানুষের জন্য তিনি কিছু করবেন বলে আমার প্রত্যাশা। তিনি বলেন, একটি বাজেট সাধারণত হিসাব-নিকাশের বিষয়। আবার বাজেটে একটি সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকে। এই বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়নযোগ্য কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে এবারের বাজেট কেবল হিসাব-নিকাশের একটি পরিসংখ্যান মাত্র। বিশাল বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্থমন্ত্রীর আছে কি না তা দেখা দরকার। তিনি বলেন, বাজেট বড় মানে এডিবিও বড়। এডিবির লক্ষ্য অর্জনে ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হবে এক মাসের মধ্যে। হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। আসলে এটা সম্ভব নয়। এতে লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে পরে বলবেন বলে কথা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। অথচ আজ পর্যন্ত এ নিয়ে তিনি আর কোনো কথা বলেননি। ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন
তিনি প্রকাশ করেননি। অথচ ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রেস কনফারেন্স করে ঘোষণা দেবেন। তদন্ত রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে তাদের বিচারের আওতায় আনেননি অর্থমন্ত্রী। পীর ফজলুর রহমান বলেন, প্রতি বছর ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অথচ জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হয় না। জনগণের ট্যাক্সের টাকা কিছু লুটেরা ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণের নাম করে নিয়ে আত্মসাৎ করে। বিদেশে পাচার করে। শেয়ার বাজারের মাধ্যমে যারা রিক্ত-নিঃস্ব হয়েছে তারা আজও জানতে পারেননি কারা এর সঙ্গে জড়িত। অর্থমন্ত্রী মনে হয় তাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাদের বিচার কেন হয় না তা সংসদের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই। তিনি বলেন, আবগারি শুল্ক সাধারণত মাদক বা তামাক থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য আরোপ করা হয়। অথচ এবারের বাজেটে টাকা জমা রাখার ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। মনে হচ্ছে জমানো টাকা যেন মদ আর গাঁজা। এক লাখ টাকা থাকা মানে তিনি সম্পদশালী-অর্থমন্ত্রী কোন যুক্তিতে এ ধরনের কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী মনে হয় মানুষের ভাষা বুঝতে পারছেন না। তাই এ শুল্ক প্রত্যাহার করা হোক। একই সুরে সমালোচনা করে জাতীয় পার্টির খোরশেদ আরা হক বলেন, এটা একটি শুভংকর ফাঁকির বাজেট। এটা আবার সুন্দর করে সাজানো হোক। বাজেট তৈরির আগে অর্থমন্ত্রী কারও মতামত নেননি কেন? উনি তো কারও কথা বুঝেন না। না বুঝেই বাজেট পেশ করেছেন। আপনি যা ইচ্ছা করে যাবেন আর আমরা সহ্য করে যাবো। তার বাজেটে শুধু গরিবরা মরবেন না ধনীরাও তো মরবেন। তিনি বলেন, এই বাজেটে নারীদের জন্য তেমন কিছু বলা হয়নি। উল্টো নারীরা আরো আর্থিক কষ্টে পড়বেন। টক শো নিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আরো কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে টেলিভিশনের টক শো বন্ধ করে দিতে হবে। এদিকে সরকারি দলের পঞ্চানন বিশ্বাস বলেন, ব্যবসায়ীরা এবারের বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব বলেছেন। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। সরকার তাদের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাটের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হচ্ছে। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে আসলে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে মূর্তি সরানো নিয়ে কেউ কেউ হেফাজতের সঙ্গে সখ্যতার কথা বলেছেন। এর আগে জামায়াতের মতো ইসলামী দলের সঙ্গে আতাত করে বিএনপি অপরাজনীতি করেছে। তখন বেগম জিয়া রাজনীতি নিয়ে কম খেলেননি। একইভাবে হেফাজতের ধূর্তরা শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তারা একটি মূর্তি সরানোর পর দেশের সব মূর্তি সরানোর দাবি জানান। তাদের এ দাবি মানা হলে দেশে মৌলবাদীকে উৎসাহিত করা হবে। তিনি বলেন, সরকারের মনোবল ভাঙ্গার জন্য উগ্র মৌলবাদীরা দেশে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। দলমত নির্বিশেষে এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত করে বিচার না করলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। এমপি আবু জাহির বলেন, বাজেট উপস্থাপনের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা নেই। অথচ বিএনপি বিভিন্ন গণমাধ্যমে মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই। সরকারের উন্নয়ন দেখে বেগম খালেদা জিয়া দিশাহারা। পবিত্র রমজান মাসে তিনি যেভাবে টেলিভিশনের সামনে আসছেন তা দেখে মনে হয় না তিনি রোজা রাখেন। তার ওপর মিডিয়ার সামনে একের পর এক মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছেন। আদালতের মাধ্যমে মওদুদ আহমদের বাড়ি দখলমুক্ত করার পর বিএনপি নেত্রী বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করা হবে। আমি তার এ বক্তব্যর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। কারণ বেগম জিয়া ও মওদুদের বাড়ি দখলমুক্ত করা হয়েছে আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে। এখানে সরকারের কোনো হাত নেই। এমপি কাজী কেরামত আলী বলেন, এটা একটি স্বপ্নের বাজেট। তবে ভ্যাটের পরিমাণ কমাতে হবে। সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। আমানতের ওপর শুল্ক কমিয়ে দেয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আশা করি তিনি এ বিষয়ে কথা রাখবেন। ওয়ার্কার্স পার্টির টিপু সুলতান বলেন, অতীতে বাজেটের যে পরিমাণ বাস্তবায়ন করেছি তাতে মনে হয় এবারও আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো। ১৫ ভাগ ভ্যাট ও আমানতের ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। বাজেট আলোচনায় আরো অংশ নেন সরকারদলীয় এমপি আফতাব উদ্দিন সরকার, আবদুল মালেক, আবদুল মজিদ খান, সংরক্ষিত আসনের বেগম আমিনা আহমেদ, কুড়িগ্রামের জাতীয় পার্টি (জেপি) এমপি মো. রুহুল আমিন প্রমুখ।