দেশের মাটি ও মানুষের দল আওয়ামী লীগের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সেনাশাসনের উচ্ছিষ্টভোগী রাজনৈতিক দল বিএনপি’রই বরং পায়ের তলায় মাটি নেই। কারণ এ দল মাটি থেকে গড়ে ওঠে নাই।
তিনি বলেন, ‘এ দল সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতার উচ্চ শিখরে বসে। কাজেই ক্ষমতার উচ্চশিখরে বসে যে দল তৈরি হয় তারই পায়ের নিচে মাটি থাকে না বা শিকড় থাকে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। ‘
সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই- বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএফইউজে এবং ডিইউজে আয়োজিত সাংবাদিকদের সঙ্গে ইফতার ও দোয়া মাহফিলে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা এবং পরবর্তিতে অবৈধ ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে দেশে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি প্রবর্তনের জন্য সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করে তার তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে দেশে কারফিউ গণতন্ত্র প্রবর্তনের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেন।
জিয়া এবং খালেদা জিয়ার শাসনামলে দেশবাসীর নাভিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা এবং বিদেশের আদালতে প্রমাণ সাপেক্ষে বেগম জিয়া পুত্রদের অর্থপাচারেরও উল্লেখ করেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে সাংবাদিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় সাংবাদিকরা সত্যিই এক বিভীষিকাময় অবস্থা পার করেছে। শত শত সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও ওই সময় একটি সাংবাদিক হত্যারও বিচার করা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হারুন-অর-রশিদ, সরদার শুকুর হোসেন, হুমায়ুন কবির বালু, মানিক চন্দ্র সাহা, শেখ বেলাল উদ্দিন, কামাল হোসেন, দীপঙ্কর চক্রবর্তী, শহীদ আনোয়ার, সৈয়দ ফারুক আহমেদ, গোলাম মাহফুজ ও নাবিল আব্দুল লতিফসহ ১৬ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, জোট সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০০টি মামলা দায়ের এবং ৮০০ বারেরও বেশি হুমকি-হামলার ঘটনা ঘটে। বিভীষিকাময় নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক সংবাদকর্মী জীবন বাঁচাতে নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন।
জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ইনস্টিটিউট, রেডিও, টেলিভিশন সর্বত্র দলীয়করণ করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে সকল হত্যাকাণ্ডের যেমন বিচার হচ্ছে, তেমনি সকল সাংবাদিক হত্যারও বিচার হবে। আর মানুষ পুড়িয়ে হত্যা এবং হত্যার হুকুমের আসামিদের বিচার করা হবে।
দোয়া ও ইফতার মাহফিলে অন্যান্যের মধ্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি (বিএফইউজে) মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল এবং মহাসচিব ওমর ফারুক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি শাবান মাহমুদ এবং সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বক্তৃতা করেন।
ইফতারের আগে দেশ, জাতি এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামলা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সাংবাদিকদের নতুন ওয়েজ বোর্ড গঠন সম্পর্কে সরকারের অবস্থান এবং সাংবাদিক কল্যাণে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবাদপত্রকে ‘সেবা শিল্প খাত’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
নতুন ওয়েজবোর্ডের কথা বলা হয়েছে। আমরা কিন্তু নতুন ওয়েজবোর্ড করে দিয়েছি। যেখানে আটকে আছে সেখানে কিন্তু আমাদের দোষ নয়, সরকারের দোষ না। আটকে আছে মালিকদের কারণে (সংবাদপত্র শিল্প মালিক)। এখানে মালিকদের যে প্রতিনিধি দেয়া দরকার সেখানে কিন্তু এখনও মালিকদের প্রতিনিধি দেয়া হয় নাই। এখানে সংবাদপত্রের অনেক মালিকরাও উপস্থিত আছেন, কাজেই আমি আহ্বান জানাবো মালিকদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দিলেই ওয়েজবোর্ড কার্যকরভাবে কাজ শুরু করতে পারে। কাজেই সেটা আশাকরি আপনারা করবেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সকলের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা যারা আছেন, আমি জানি এখানে অনেকেই অত্যন্ত মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছেন- আবার যারা বয়োবৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তাদেরও অনেকেরই ভবিষ্যত কি? ভবিষ্যত অন্ধকার। এরকমই একটা অবস্থা। আসলে এসব বিষয়গুলিও একটু দেখা দরকার এবং আমরা চাচ্ছি মালিকরা ওয়েজবোর্ডে তাদের সদস্য দেবেন এবং সুপারিশ করবেন, ওয়েজ বোর্ড চালু হবে এবং আমি চাই প্রত্যেক সংবাদপত্রের মালিক এই ওয়েজবোর্ড মেনে চলবেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রী ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও একটি নীতিমালার মধ্যে থেকে তাদেরও ওয়েজবোর্ডে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন।
নীতিহীন বা হলুদ সাংবাদিকতার নেতিবাচক দিক তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নীতিহীন সাংবাদিকতা বা যেটাকে বলা হয় হলুদ সাংবাদিকতা সেটা কিন্তু কখনো গ্রহণযোগ্য না। কারণ এর ফলে দেশ, জাতি ও মানুষের ক্ষতি। ‘
প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতাকে উদ্ধৃত করে বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, রাজনীতির নীতি থাকতে হবে, সাংবাদিকতারও নীতি থাকতে হবে।
আমরা সেই নীতিতে বিশাস করি। নীতিহীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করি না। নীতিহীন রাজনীতি কখনো কোন দেশ ও জাতিকে কিছু দিতে পারে না।
তিনি বলেন, আমরা দেশে সর্বপ্রথম জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাসহ তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। ২০০৯ সাল থেকে গণমাধ্যমের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। ৬২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। আরো কার্যক্রম চলমান আছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন-২০১৪ প্রণয়নসহ ১৮টি আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের গত ৮ বছরে ৭ শতাধিক পত্রিকার নতুন করে নিবন্ধন প্রদান এবং বেসরকারিখাতে ৪৬টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে সরকার থেকে পাঁচ কোটি টাকার সিডমানি, ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার অনুদান এবং ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছি। সাংবাদিকদের সহায়তায় এ পর্যন্ত ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাংবাদিকদের জন্য এক কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানান।
তিনি বলেন, মামলায় সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক ও প্রতিবেদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরাসরি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিধান বাতিল করেছি। সংশোধিত আইনে সরাসরি গ্রেফতারি পরোয়ানার পরিবর্তে সমন জারি করতে হবে।
তিনি এ সময় সাংবাদিকদের আবাসন সমস্যা সমাধানে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিকদের আবাসন সমস্যা মোকাবিলায় ৫ ভাগ কোটা বরাদ্দ দিয়ে প্লট প্রদান করা হয়েছে। ’৭৪ এ বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জন্য যে আইন তৈরি করেছিলেন তা পুনর্বহালের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের আবাসিক সমস্যা সম্পর্কে আমরা সচেতন। সাংবাদিকরা উত্তরায় দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে ফ্ল্যাট কিনতে পারেন। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা নানা আবাসিক প্রকল্পের সুযোগ নিতে পারেন।
বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গি এবং মাদকের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তিনি জঙ্গিবাদ দমনেও সাংবাদিক সমাজকে সোচ্চার হয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।