বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়াই গতকাল মঙ্গলবার উপকূল অতিক্রম করেছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। মহা বিপত্সংকেত জারি করা হলেও উপকূলের কাছাকাছি আসতে আসতেই খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারেনি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। গতকাল সকাল ৬টার দিকে প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি সঙ্গী করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম শুরু করে ‘মোরা’। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি। তবে ভাটার সময় থাকায় জলোচ্ছ্বাস তীব্র হয়ে উঠতে পারেনি। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঝড়ের শক্তি কমে আসতে থাকে। ঝড়ের সময় কক্সবাজার, ভোলা ও রাঙামাটিতে নারী ও শিশুসহ আটজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন গাছচাপা পড়ে এবং একজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। শেষ খবর অনুযায়ী, স্থলভাগে এসে ক্রমেই দুর্বল হয়ে ‘মোরা’ স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয় এবং রাঙামাটি হয়ে ভারতের ত্রিপুরার দিকে চলে যায়।
ঝড়ের তোড়ে উপকূলীয় জেলাগুলোতে বিপুলসংখ্যক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ২৬ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফসলেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের বিপদ কেটে যাওয়ায় সোমবার রাতে বিভিন্ন জেলায় আশ্রয়কেন্দ্রে রাত কাটানো কয়েক লাখ মানুষ গতকাল বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে যায়।
ঝড় দুর্বল হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহা বিপত্সংকেত নামিয়ে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরগুলোকে ৮ নম্বর বিপত্সংকেত নামিয়ে ২ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতর থেকে পণ্য সরবরাহের কাজ গতকাল বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয়েছে। তবে জাহাজ জেটিতে ভিড়বে আজ বুধবার সকাল থেকে। এরপর পুরোদমে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ শুরু হবে। ঝড়ের পর চট্টগ্রামের শাহ আমানত এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সারা দেশে নৌযান চলাচলও শুরু হয়েছে। গতকাল দুপুর ২টার পর থেকে লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দিয়েছে বিআইডাব্লিউটিএ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ‘মোরা’ গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত টানা প্রবল বৃষ্টি আর ঝোড়ো বাতাসের মধ্য দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। পরে শক্তি হারিয়ে সেটি রাঙামাটি হয়ে ভারতের ত্রিপুরার দিকে যায়। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টি ঝরিয়ে সেটির ইতি ঘটবে।
আবহাওয়া কর্মকর্তা বজলুর রশিদ গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির শক্তি অনেকটাই ক্ষয় হয়ে গেছে। রাঙামাটি দিয়ে ত্রিপুরা যাওয়ার সময় স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে সেটি। সে জন্য সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সব ধরনের মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র প্রভাবে গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোথাও গুঁড়ি গুঁড়ি, কোথাও ভারি বর্ষণ হয়েছে। রাজধানীতে গতকাল তিন মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে মাদারীপুরে, ৪৩ মিলিমিটার। ঝড়ের প্রভাবে আজও দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হতে পারে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হবে। অন্য জেলায়ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এক কোটি ৮৭ লাখ টাকার জরুরি ত্রাণ বরাদ্দ পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল সচিবালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ঝড়ে ২০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। নৌবাহিনীর একটি জাহাজে করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আটজনের মৃত্যু : গতকাল ঝড়ের সময় কক্সবাজার জেলায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে চারজন গাছচাপা পড়ে এবং আরেকজন আশ্রয়কেন্দ্রে ঝড়ের আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে অন্তত ২৫ জন।
জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ভোরে চকরিয়ার পূর্ব বড় ভেওলার সায়েরা খাতুন (৬৫), ডুলাহাজারার রহমতুল্লাহ (৫০), কক্সবাজার সদরের ইসলামাবাদের শাহিনা আকতার (১০) ও পেকুয়ার আ. হানিফ (৪০) গাছচাপায় মারা গেছে। সোমবার রাতে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কক্সবাজার সদরের ৬ নম্বর জেটি এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগম (৫৫)।
গতকাল দুপুরের দিকে রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী সড়ক ও জনপদ বিভাগের কারখানা বিভাগ এলাকায় একটি বসতঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে। এতে রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী মাহিমা আক্তার (১৪) ঘটনাস্থলেই মারা যায়। প্রায় একই সময় শহরের আসাম বস্তি এলাকায় ঘরের ওপর গাছ পড়লে মারা যান হাজেরা বেগম (৪৫) নামের এক নারী। তাঁর ছেলে জুনায়েদ (৫) গুরুতর আহত হয়।
ভোলার মনপুরার বিচ্ছিন্ন কলাতলী চরে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে মায়ের কোল থেকে পড়ে রাশেদ (১) নামের একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত ১টার দিকে কলাতলী চরের আবাসন এলাকা থেকে মনির বাজার কলাতলীর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে মায়ের কোল থেকে পড়ে যায় রাশেদ। মনপুরা ইউনিয়নের কলাতলী চরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সালাউদ্দিন ও জরিফা খাতুনের ছেলে রাশেদ। তবে ভোলার জেলা প্রশাসক সেলিম উদ্দিন বলেন, শিশুটি নিউমোনিয়া রোগে মারা গেছে।
কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, বিদ্যুৎ নেই : গতকাল সকালে ঝড়ের তোড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে আনোয়ারা পারকি সৈকতে গিয়ে ঠেকেছে একটি জাহাজ। ঝড় দুর্বল হয়ে পড়ায় দুপুর ২টা থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম চালু করা হয়। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার মো. রিয়াজুল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ২টা থেকে বিমানবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকেল ৪টা থেকে পণ্য সরবরাহ দিতে আমরা প্রস্তুত আছি। তবে জেটিতে জাহাজ ভিড়বে বুধবার সকালে। ’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কক্সবাজার ও খেপুপাড়া রাডার পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, ‘মোরা’ গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে কুতুবদিয়ার কাছ দিয়ে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে। আবহাওয়া অধিদপ্তর পতেঙ্গা কার্যালয়ের ডিউটি অফিসার ছৈয়দা পারভিন মিমি জানান, ভারি বর্ষণের মধ্য দিয়ে ‘মোরা’ দুর্বল হয়ে পড়েছে। গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৬৬ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বুধবারও (আজ) বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন গতকাল সকাল ৯টা থেকে নগরের দক্ষিণ পতেঙ্গা, উত্তর পতেঙ্গা, দক্ষিণ হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন শুরু করেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইশতিয়াক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপসহ অন্য উপজেলাগুলো থেকে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। উপকূলীয় উপজেলাসহ আশপাশের অন্য উপজেলাগুলোতে অনেক কাঁচা ঘর ও বৈদ্যুতিক লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে তাত্ক্ষণিক হিসাব পাওয়া যায়নি। উপজেলা প্রশাসন ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ করছে। দুপুরের পরই চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী দুর্গত এলাকা দেখতে বাঁশখালী যান। সেখানে তিনি দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, বোয়ালখালী, হাটহাজারী থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোতে অন্তত ছয় হাজার ঘর সম্পূর্ণ ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। বাঁশখালীতে আড়াই হাজার ঘর সম্পূর্ণ এবং এক হাজার ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসন। সেখানে অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়েছে।
ঝড়ের কারণে সন্দ্বীপে প্রায় এক হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনও মো. গোলাম জাকারিয়া। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১০ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুপুরের পর আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে মানুষ বাড়ি ফিরে গেছে।
লোহাগাড়ার পদুয়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি থেকে পদুয়া পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থানে গাছ ভেঙে পড়েছে। পল্লী বিদ্যুতের লোহাগাড়া কার্যালয়ের ডিজিএম মো. বেলায়েত হোসেন জানান, অর্ধশতাধিক খুঁটি ভেঙে পড়ায় ও গাছপালা উপড়ে পড়ায় বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেছে।
সাতকানিয়ার ইউএনও মোহাম্মদ উল্যাহ জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপজেলার অন্তত আড়াই শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে খুঁটি উপড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে।
আনোয়ারার ইউএনও গৌতম বাড়ৈ জানিয়েছেন, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ২১৫টি ঘর সম্পূর্ণ এবং আট শতাধিক কাঁচা ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। পুরো উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। দুপুরের পর আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে মানুষ বাড়ি ফিরে গেছে।
তবে ঝড়ের মধ্যেও স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত ছিল চট্টগ্রাম ইপিজেডে। সিইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক মো. খুরশীদ আলম বলেন, ‘সোমবার রাতের শিফট বন্ধ রাখা হলেও মঙ্গলবার দিনের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। ’
ঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজার জেলায় ২০ হাজারের বেশি কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি। ৫২ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জেলা প্রশাসন ১০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ এক লাখ টাকা বিতরণ করেছে। জেলা প্রশাসন এসব তথ্য জানিয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন গতকাল সংবাদকর্মীদের জানান, ঝড়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে। সোমবার মধ্যরাত থেকে গতকাল সকাল ৯টা-১০টা পর্যন্ত ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেছে সেখানে। সেন্ট মার্টিনসের সঙ্গে মোবাইল ফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে সোমবার রাত ৩টার পর থেকেই।
দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ কালের কণ্ঠকে জানান, দ্বীপের পাঁচ শতাধিক ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝড়ে বালুচরে আছড়ে পড়ে শতাধিক মাছ ধরার নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন দিন ধরে টেকনাফের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় দ্বীপের লোকজনও খাদ্য সংকটে পড়েছে।
ঝড়ে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন, শাহপরির দ্বীপ, বাহারছড়া ইউনিয়ন, উখিয়ার জালিয়া পালং, কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদণ্ডি, পোকখালী, মহেশখালী দ্বীপের ধলঘাটা, মাতারবাড়ী, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া দ্বীপের উত্তর ধুরুং, আলী আকবর ডেইল ও ধুরুং, পেকুয়া উপজেলার মগনামা, উজানটিয়া ও রাজাখালী ইউনিয়ন এবং চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের কয়েকটি স্থানে গাছ ভেঙে পড়ে গতকাল কয়েক ঘণ্টা ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।
ঝড়ের প্রভাবে উখিয়া ও টেকনাফের কুতুপালং, বালুখালী, লেদা ও নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের বস্তিও লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এসব শিবিরের কমপক্ষে সাত হাজার ঝুপড়ি ধসে পড়েছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সেবা দেওয়া হচ্ছে।
সেন্ট মার্টিনস ও কুতুবদিয়া দ্বীপে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে জরুরি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। জরুরি খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী নিয়ে দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার তত্পরতার জন্য নৌবাহিনী যুদ্ধজাহাজ ‘সমুদ্র অভিযান’ ও ‘খাদেম’ নিয়ে দুর্গত এলাকায় যায়।
মোংলা বন্দরে কাজ শুরু : ঝড়ের প্রভাব কেটে যাওয়ায় মোংলা সমুদ্রবন্দরে জাহাজে মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজ শুরু হয়েছে। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে আশ্রয় নেওয়া জেলেরাও তাদের ট্রলার ও নৌকা নিয়ে ফিরে যেতে শুরু করেছে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস জানান, বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলা উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৪ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যে তারা বাড়ি ফিরে গেছে।
ঝড়ের প্রভাব কমে যাওয়ায় বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের সব রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর গতকাল বিকেল ৩টা থেকে চাঁদপুর-ঢাকা ও চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জসহ দক্ষিণাঞ্চল রুটে নদীপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল শুরু হয়।
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর পুনর্বাসন : উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পরই পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গতকাল এ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা এ তথ্য জানান।
ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বলতে গেলে খুবই কম। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও অন্য জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ করছেন। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব আমরা শিগগির পেয়ে যাব। সে অনুযায়ী কাজ করব। ’
গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘যেখানে বাড়িঘর দরকার হবে আমরা বাড়িঘর করে দেব। কৃষি পুনর্বাসনের জন্য যা দরকার তা দেবে কৃষি মন্ত্রণালয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নিয়ে কাজ করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৪ জেলায় এক হাজার ৪০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মহা বিপত্সংকেত জারির পর চার লাখ ৬৮ হাজার মানুষকে তিন হাজার ৬০০ আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া অনেকে মসজিদ, মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। ’
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক এবং বরিশাল অফিস, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, ভোলা, রাঙামাটি, বাগেরহাট ও চাঁদপুর প্রতিনিধি)