বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায় জঙ্গি সন্দেহে চালানো র্যাবের প্রশ্নবিদ্ধ অভিযানের পর মুক্তি পাওয়া একজন তরুণ এবং অন্যদের পরিবারে সদস্যরা বলছেন, সাম্প্রতিক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে হতাহতের ঘটনা তাদের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি করেছিল।
শনিবার জেলার সদর উপজেলার একটি বাড়ি থেকে আত্মসমর্পণ করা পাঁচ জনকে হেফাজতে নিয়েছিল র্যাব। পরে তিনজনকে রোববার গভীর রাতে ছেড়ে দেয়। ওই ঘটনায় আটক দুজনসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করে সোমবার সন্ত্রাস-বিরোধী আইনে মামলা করেছে র্যাব।
জঙ্গি সন্দেহে অভিযানে আটক হওয়া একজন বাসিকুল ইসলাম। নরসিংদীর কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে এমবিএ পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন গত ১৮ই মে।
গত শনিবার সকালে কর-পরিদর্শক পদের জন্য পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে নরসিংদীতে ফেরেন ওইদিন বিকেলে। ওইদিন বিকেলের দিকে ভাড়া করা মেস-বাড়িতে হঠাৎ বাইরে থেকে তাদের কক্ষের দরোজার ছিটিকনি বন্ধ করে দেয়া হয়।
“বিকেলের দিকে ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ার পর সামনেই একটু জায়গা আছে, সেখানে দাঁত ব্রাশ করছিলাম। হঠাৎ দেখি বুট পরা অনেক লোক। তাদের একজন এসে আমার হাত ধরে বলে – ‘কই যান?’। তারপর আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরোজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেন। ”
“এরপর জানালা দিয়ে দেখলাম বাইরে প্রচুর র্যাব-পুলিশ। তখন বুঝলাম আমাদের টার্গেট করা হয়েছে, আমাদের মেসটাকে”।
সারাদেশে সাম্প্রতিক জঙ্গি বিরোধী অভিযানে এর আগে একাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ফলে তাদের বাসার বাইরে র্যাব বা পুলিশের উপস্থিতি তাদের মধ্যে উদ্বেগ আর আতঙ্ক তৈরি করে। সে ভাবেই সারারাত কেটে যায়, জানান বাসিকুল ইসলাম।
“সারারাত সজাগ ছিলাম। তিনটি কক্ষের মধ্যে ডাইনিং রুমে(খাবার ঘরে) ছিলাম আমরা। কতক্ষণ মেঝেতে বেসে ছিলাম। কতক্ষণ চেয়ারে। কেউ নামাজ পড়ছিলাম। কেউ কোরআন পড়ছিলাম”।
মি. ইসলাম জানান, ভবিষ্যতে তার চাকরি বা অন্যক্ষেত্রে এর কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি-না সেটি নিয়েও উদ্বেগ কাজ করেছে তার মাঝে।
এদিকে একতলা ওই বাসাটি ভাড়া নিয়ে যে কজন বসবাস করতেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং নরসিংদীর সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা ছিলেন। বাসিকুল ইসলাম জানান, র্যাবের সদস্যদের কাছে তারা বারবার নিজেদের নিরপরাধ দাবি করে তথ্য পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তবে সকালের আগ পর্যন্ত সাড়া মেলেনি।
সকালে র্যাব সদস্যরা তাদের বাড়ির ভেতর থেকে খালি গায়ে বের বের হেয় আসার নির্দেশ দেন। এরপর বুলেটপ্রুফ পোশাক পরিয়ে এবং কালো কাপড়ে তাদের চোখ-মুখ ঢেকে দিয়ে গাড়িতে তোলা হয়, জানান বাসিকুল ইসলাম।
“এরপর ছোট্ট একটি সেলে আটকে রেখে কয়েক-দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই সেলের মধ্যে একজন মানুষ লম্বা হয়ে শুতে পারবে না। একটা সময় চোখ খুলে দেয়া হয়। অনেকক্ষণ পরে আবার চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় একটি কক্ষে। সেখানে আমাদের আত্মীয় স্বজনরা ছিল। তারপর আবার আমাদের তথ্য নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় এবং র্যারেব পক্ষ থেকে দু:খ প্রকাশ করা হয়”।
রাত সাড়ে বারোটার পর ছাড়া পান মি. ইসলাম।
ওই বাসার অপর বাসিন্দাদের মধ্যে আবুজাফর এবং মোঃ সালাউদ্দিন নামে দুজনের কাছে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসতো। তেমনই একজন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র মাসুদুর রহমান ভেতরে আটকা পড়েন। ঘটনার পর থেকে মানসিকভাবে সে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে তার পরিবার জানিয়েছে।
তার ভাই আব্দুর রহমান টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে জানান, “এখন আসলে সে খুবই ভয় পেয়েছে। ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় বের হওয়ার পর আমাদের সাথেও বেশি কথা বলেনি। ছোট মানুষ এই বয়সে এতটা মেন্টাল হ্যারাসমেন্ট(মানসিক হয়রানি) হয়েছে…। আমরা চাই সে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠুক”।
র্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে তিনি সহ আটক অন্যদের পরিবারের সদস্যরা ওই বাড়ির সামনেই সারারাত অবস্থা করেন। মি রহমান বলেন, “র্যাবের ওইখানে যিনি অভিযান পরিচালনা করেছেন তিনি আমাদের সকাল ৮টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন। পাশেই একটি প্রাচীর ঘেরা বাড়ির সীমানার মধ্যে আমরা যারা নিকটাত্মীয় ভাইবোনরা ছিলাম তাদের রাখা হয়। সকালে তাদের নারায়ণগঞ্জ র্যাব-১১ এর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ”
“পরের দিন বিকেল সাড়ে চারটার পর আমাদের ফোনে জানানো হয় আপনার ভাই নির্দোষ তাকে এসে নিয়ে যান এবং বলা হয় আমরা আন্তরিকভাবে দু:খিত”।
পরিবারের স্বজনরাই সাংবাদিকদের কাছে ভেতরে আটক থাকা তরুণদের মোবাইল ফোনের নম্বর সরবরাহ করেন, জানান মি রহমান। এছাড়া ভেতর থেকে একজন তাদের বাঁচানোর জন্য আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। এভাবে মিডিয়াতেও দ্রুত এ সংক্রান্ত খবর চলে আসে।
যদিও ১৮ ঘণ্টা ঘিরে রাখার পর বাড়িটির ভেতর থেকে অস্ত্র বা সন্দেহজনক কিছুই পায়নি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।