শনিবার মামলা দায়েরের পর থেকে আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে, পুলিশের এমন দাবির মধ্যেও শাফাত আহমেদ নির্বিঘ্নে ঢাকা ছাড়ায় চাপে আছেন ঘটনার শিকার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। এ মামলার অন্য আসামি নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ, শাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ।
এদিকে শাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব নিরাপত্তা চেয়ে ভাটারা থানায় জিডি করেছেন।
সিলেটের রিজেন্ট রিসোর্টের একজন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, একটি প্রাইভেট কারে করে গত সোমবার পাঁচজন তাঁদের রিসোর্টে আসেন। একজন নিজেকে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে শাফাত আহমেদ বলে পরিচয় দেন।
রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের ছবি তুলতে চাইলে তিনি গড়িমসি শুরু করেন। মিনিট ১৫ পর তিনি সঙ্গীসহ রিসোর্ট থেকে চলে যান।
রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ পরে বিভিন্ন জায়গায় ছবি দেখে শাফাতকে চিনতে পারে। তাঁরা বিষয়টি পুলিশকে জানান। মহানগর পুলিশের উপকমিশনার জেদান আল মুসা (গণমাধ্যম) বলেন, রিসোর্ট থেকে শাফাত ও তাঁর সঙ্গীরা কোথায় গেলেন, সে বিষয়ে পুলিশ খোঁজ নিচ্ছে। শাফাত যে রিসোর্টটিতে থাকতে চেয়েছিলেন বলে জানা যাচ্ছে, তার কাছেই সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের নগর গ্রামে তাঁদের পৈতৃক বাড়ি। গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে ফজলুল হক বলেছেন, শাফাত তাঁদের গ্রামের বাড়িতে নেই।
এদিকে শাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। শাফাত আহমেদের বাবা আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদ বলেন, বছর দুয়েক আগে ফারিয়ার সঙ্গে তাঁর ছেলের বিয়ে হয়েছিল আর মাস দুয়েক আগে বিচ্ছেদ হয়। ছেলেকে ফাঁসাতে ফারিয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ২৮ মার্চ জন্মদিনের পার্টিতে পাঠান। চক্রান্তের অংশ হিসেবে ৫ মে ওই দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফারিয়াও বনানী থানায় যান।
ফারিয়া মাহবুব গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, তিনি থানায় গিয়েছিলেন। তবে সেটা বাদীদের অনুরোধে। এখন ধর্ষণের অভিযোগ থেকে সবার দৃষ্টি সরাতে দিলদার আহমেদ তাঁর নামে অভিযোগ করছেন। ২৮ মার্চ ধর্ষণের ঘটনা ঘটার ১০-১২ দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা তাঁকে পুরো ঘটনা জানান। আর তাঁকে শাফাত তালাকের চিঠি দেন ৮ মার্চ।
ফারিয়া বলেন, ডিসেম্বরে অরিজিৎ সিংয়ের ঢাকায় কনসার্টে নাঈম আশরাফের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় শাফাতের। নাইমের প্রতিষ্ঠান এটি আয়োজন করে। এরপর থেকে কখনো শাফাত নিজে, আবার কখনো নাঈমের মাধ্যমে নিজেই বিভিন্ন মডেলকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে বলতেন। অনেক মডেলই বিব্রত বোধ করেন বলে তাঁরা ফারিয়াকে বলেছেন। ফারিয়া নিজেও একজন মডেল।
একই ভাষ্য পাওয়া গেছে মামলার বাদীর কাছ থেকে। তিনি বলেন, ঘটনার পর তাঁরা শাফাত-সাদমানের দুজন ‘বড় ভাই’কে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। তাঁরা পুলিশের কাছে যেতে চাইলে ওই দুই বড় ভাই বিষয়টা মীমাংসা করে নিতে বলেন। তাঁরা এই বলে সতর্ক করেন যে ধর্ষণের শিকার মেয়েদের বিয়ে হতে অসুবিধা হবে। ওই দুই বড় ভাইয়ের মধ্যস্থতায় শাফাত ভিডিও মুছে ফেলার প্রতিশ্রুতি দেন।
আসামিরা পলাতক থাকায় এ বিষয়ে তাঁদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ২৮ মার্চ রাতে মামলার বাদী ও তাঁর বান্ধবী ছাড়া তাঁদের আরও দুই বন্ধুকে পাশের ঘরে আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে। ওই বন্ধুর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
তল্লাশি, মামলা উইমেন সাপোর্ট সেন্টারে
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ গুলশানে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। গুলশান অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল আহাদ বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তাঁরা পালিয়ে আছেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শাফাত আহমেদের বাবা দিলদার আহমেদ বলেন, গতকাল তাঁর ছেলে বাসা থেকে বেরোনোর পর আর ফেরেননি।
গতকাল মামলাটি বনানী থানা থেকে উইমেন সাপোর্ট সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও (ডিবি) কাজ করছে বলে জানা গেছে। এর আগে মামলার বাদীকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন।
আজ থেকে কাজ শুরু করবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
ধর্ষণের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পাঁচ সদস্যের কমিটি আজ থেকে কাজ শুরু করবে। তারা প্রয়োজনীয় স্থান পরিদর্শন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দেবে।
এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গতকাল বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গতকাল মঙ্গলবার পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, অভিযোগ দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সক্রিয় হলে আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হতো।
খুলনা জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে ‘ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস’ শীর্ষক পরামর্শ সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার এক মাস পরও পুলিশ কোনো কিছু জানল না, তারা কোনো কিছু করতেই পারল না; তাহলে পুলিশের প্রয়োজনটা আমাদের কী জন্য? এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। বনানীর ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও গাফিলতি ছিল।’