কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ শনিবার সকাল ১১টায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়কটি উদ্বোধন করেন।
মেরিন ড্রাইভের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ দেশবাসীর আনন্দের দিন। মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধনের ফলে বিশ্ব পর্যটনশিল্পে এর প্রভাব পড়বে। এটি প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডে পরিণত হবে। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ্য হবে, এলাকাবাসীর আর্থ সামাজিক অবস্থার পবিবর্তন হবে এবং নিশ্চিত হবে নিরাপত্তা। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধনের মাধ্যমে পর্যটনশিল্পসহ সার্বিক উন্নয়নেরও নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। ‘
এ উপলক্ষে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের ইনানীতে সেনাবাহিনী আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান আবু বেলাল মো. শফিউল হক প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক। অনুষ্ঠানে মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা শরিফুল ইসলাম।
মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ত্যাগের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়েই সেনা সদস্যরা দীর্ঘদিনের কঠোর প্ররিশ্রমে নির্মাণ কাজ শেষ করেছেন মেরিন ড্রাইভ সড়কের। ‘ ২০১০ সালের ১৫ জুন টানা ভারি বর্ষণের ফলে পাহাড়ধসে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণে নিয়োজিত ছয় সেনা সদস্যর প্রাণহানির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ একদিকে আনন্দের দিন হলেও অন্যদিকে বেদনার দিনও। আমি পাহাড়ধসে নিহত ছয় সেনা সদস্যর রুহের মাগফেরাত কামনা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। ‘
মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধন উপলক্ষে কক্সবাজারের ইনানী সৈকত তীরে সেনাবাহিনীর ১৬ নির্মাণ প্রকৌশল ব্যাটালিয়ান (১৬-ইসিবি) আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘সেদিনের কক্সবাজার আর এদিনের কক্সবাজারের মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ রয়েছে। আগে কক্সবাজার সাগরপাড়ে কিছু কটেজ ছিল। কিন্তু এখন কক্সবাজার বলতে অনেক বিস্তৃত এলাকা। আমি ১৯৬২ সালে বাবার হাত ধরে সর্বপ্রথম কক্সবাজার বেড়াতে আসি। সেই থেকেই কক্সবাজারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার। ‘
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীতে আরো সমুদ্রসৈকত রয়েছে। কিন্তু কক্সবাজারের দীর্ঘ ১২০ কিলোমিটারের বালুকাময় সৈকত আর কোথাও নেই। দেশের অন্যতম সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা কক্সবাজারের সৌন্দর্যবৃদ্ধির মাধ্যমে এলাকাটিকে পর্যটনের বিকাশ ঘটানো আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। তাই আজ উদ্বোধন করা হলো যে মেরিন ড্রাইভ সড়কের, সেটি পর্যটন বিকাশে এক অনন্য ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ‘ দেশের প্রধান পর্যটন শহর কক্সবাজারে যাতায়াতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, ‘কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কটিও চার লেইনে উন্নীত করা হবে। ‘
আজ শনিবার সকালে রাজধানী ঢাকা থেকে সুপরিসর বিমানের বোয়িং-৭৩৭ ফ্লাইটে চড়ে কক্সবাজার বিমান বন্দরে আসার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ আমি কক্সবাজার বিমান বন্দরে নেমে বোয়িং বিমান চলাচল উদ্বোধন করেছি। এখন থেকে অন্তত রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সপ্তাহে একদিন করে হলেও বোয়িং-৭৩৭ ফ্লাইট চলাচল করবে। এতে কক্সবাজারে আরো অধিক সংখ্যক পর্যটকের সমাগম হবার সুযোগ সৃষ্টি হলো। ‘ প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ‘২০১৫ সালেই কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে রূপান্তরের কাজ শুরু করা হয়। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বোয়িং বিমান চলাচলের উপযোগী হয়েছে রানওয়ে। ভবিষ্যতে কক্সবাজার বিমানবন্দরেই আন্তর্জাতিক বিমানের রি-ফুয়েলিং করার ব্যবস্থা চালু করা হবে। ‘
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এতে বলা হয়, কক্সবাজারের কক্সবাজার শহরের কলাতলি থেকে টেকনাফের সাবরাং অর্থনৈতিক জোন পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ সড়কটি নির্মাণে সময় লেগেছে ২৪ বছর। ১৯৯৩ সালে শুরু হওয়া মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশল ব্যাটালিয়ন। প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৪০ কোটি টাকা। ”
প্রামাণ্যচিত্রে আরো বলা হয়, বিশ্ব পর্যটনের দুয়ার খুলতে চলেছে সড়কটি। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক বলেও জানান তিনি। পাহাড় আর সাগরের মিতালীর অপূর্ব দৃশ্য ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে সড়কটি। সড়কের একপাশে উঁচু পাহাড়ে সবুজের হাতছানি। অপর পাশে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালিয়াড়ির বুকে। এ দুইয়ের বুক চিরে মাঝখানে নদীর মতো এগিয়ে গেছে স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ সড়ক। সড়কের ধারে রয়েছে নারকেল, সুপারি, ঝাউবিথীসহ নানা প্রজাতির গুল্ম-লতা ও ফলজ গাছ-গাছালি। সাগরতীর আর পাহাড়ের পাদদেশে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাস্তব চিত্রটি এরকম।
১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে ৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। কক্সবাজার শহরের কলাতলী পয়েন্টে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঠিকাদারের নির্মিত দুই কিলোমিটার সড়ক সাগরেই বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে এ সড়কের নির্মাণকাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর প্রকৌশল নির্মাণ ব্যাটালিয়নকে। বর্তমানে সড়কটির দৈর্ঘ্য বেড়ে ৪৮ কিলোমিটার থেকে ৮০ কিলোমিটার করা হয়েছে।
তিন ধাপে নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করা হয়। প্রথম ধাপে ২৪ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে ২৪ কিলোমিটার ও তৃতীয় ধাপে ৩২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
মেরিন ড্রাইভ সড়কটি নির্মাণের জন্য সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন হতে হয় উল্লেখ করে বলা হয়, প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতায় সড়কের মাটি সাগরের উত্থাল ঢেউয়ে বিলীন হয়ে যায়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তদুপরি পাহাড়ের পাদদেশ এবং সাগরের তীর দিয়ে এরকম দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের সময় সেনাবাহিনীর ছয়জন সদস্য পাহাড়ধসে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান। তবু সেনাবাহিনী চ্যালেঞ্জের মুখে সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে একদিকে সাগরের তীরে বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহৃত হবে সড়কটি, অন্যদিকে বিস্তীর্ণ জায়গা-জমি ও ফসল রক্ষা পাবে সাগরের ভাঙন থেকে। সেইসঙ্গে পর্যটন শিল্পেও নতুন মাত্রা যোগ হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান আবু বেলাল মো. শফিউল হক তার বক্তব্যে বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভ সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধিসহ মজবুত ভিত তৈরির সুবিধার্থে ইতিমধ্যে সড়কের দুই পাশের ১১ লাখ বিভিন্ন জাতের গাছ রোপণ করা হয়েছে। ‘