বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন এবং দায়মুক্তি

Slider খুলনা গ্রাম বাংলা বিনোদন ও মিডিয়া সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সারাদেশ সারাবিশ্ব

Photo

 

 

 

 

এম আরমান খান জয়
আজ সারা পৃথিবীতে “বিশ্ব মুক্ত গনমাধ্যম দিবস” পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ক্রান্তিকালে সমালোচকের দৃষ্টি: শান্তিপূর্ণ, ন্যায়নিষ্ঠ ও অন্ত র্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকা’। । একজন সাংবাদিক হিসেবে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করে বলছি-এবারের প্রকৃত প্রতিপাদ্য বিষয় হলো “সাংবাদিকরা আরো প্রতারিত হউক”। প্রসঙ্গত, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে গত ২৬ জানুয়ারি হরতাল চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহে থাকা এটিএন নিউজের প্রতিবেদক এহসান বিন দিদার ও ক্যামেরা পারসন আব্দুল আলীমকে দুপুরের দিকে শাহবাগ থানার ভেতরে নিয়ে মারধর করে পুলিশ। কেবল এ ঘটনাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাজমুলকে আটক করে একের পর এক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আর্টিকেল-১৯-এর ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন ইন বাংলাদেশ-২০১৪’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এই হার হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর প্রায় ২৩ শতাংশ নির্যাতনই হয়েছে পুলিশও গোয়েন্দাদের হাতে। আ্যমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অধিকার, হিউমেন রাইটস ওয়াচ সহ এরকম অনেক সংগঠনের রিপোর্ট অনুযায়ি পৃথিবীতে গত ১৫ বছরে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৬৩৯ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছে। পুলিশ, রাজনীতিবীদ, বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের হাতে কমপক্ষে ৩ হাজার জন সাংবাদিক আহত হয়েছে। পঙ্গু হয়েছে আরো প্রায় ৭শ জন। বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ১৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছে। পুলিশ, রাজনীতিবীদ, সন্ত্রাসীর হাতে নির্যাতন আর আহত হয়েছে কমপক্ষে ১ হাজার জন সাংবাদিক। একটি বিষয় কোন সময়েই প্রকাশিত হয়নি, যা হলো- পুলিশ, রাজনীতিবীদ আর সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি, সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও এরকম ক্ষমতার অধিকারীদের হাতে বাংলাদেশের সকল সাংবাদিক মানসিক, অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত এবং প্রতারিত। ঘটে যাওয়া সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। সরকারের পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি, র‌্যাব সহ সকল আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা বাহীনি এমন একটি স্পর্শকাতর মামলার তদন্ত কাজ এতদিনে শেষ করেনি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে। ক্ষোভের সাথে বলতে হয়, আসলে কত দিন, বছর, মাস শেষ হলে ৪৮ ঘন্টা হয় ?
সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকদের নির্যাতনের সকল ব্যবস্থা করা হয়েছে বাংলাদেশে। সরকার, প্রভাবশালী কোন ব্যক্তি, আদালত বা এরকম কেউ ভুল করলে, অন্যায় বা অবিচার হলে তা লেখা যাবে না। লিখলে হয় নির্যাতন, মৃত্যু নয়তো আদালত অবমাননা মামলা হবে। তাহলে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম কি আসলেও স্বাধীন ? বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে মানুষের লাশ আর নারীর সভ্রমের মাধ্যমে।
সরকার এবং মাননীয় তথ্য মন্ত্রীকে কোড করে বলছি, ” বিশ্ব মুক্ত গনমাধ্যম দিবসে, কোন মুক্ত আলোচনা আপনারা করবেন, কার মুক্তির জন্য আপনারা কাজ করবেন ? দেশের গনমাধ্যমের সম্পাদকদের দ্বারা কমব্রত সাংবাদিকরা যে কত নির্যাতিত হয়, তার কোন খোজ কি আপনারা রাখেন ?
আজ অতি ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে আমার মধ্যে। বাংলাদেশের কোন মানবাধিকার সংগঠন সাংবাদিকদের জন্য কিছুই করেনি। চলমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, একটা কুকুর আর একজন সাংবাদিকের মধ্যে সামান্য একটু পার্থক্য আছে, তা হলো, রাত জেগে বা দিনের বেলাতেও পাহারা দেয়া কুকুরকে যদি গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে কেউ ফেলে, তাহলে ক্ষতবিক্ষত কুকুরটির মৃতদেহ দেখে মানুষ নাক ঢেকে চলে যায়। পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন বা হরিজন সম্প্রদায়ের কেউ এসে সেই মৃত কুকুরটির দেহ টেনে নিয়ে মাটি চাপা দেয়। সাংবাদিকদের বেলায়-কোন সাংবাদিক হত্যার শিকার হলে হয়তো দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলবেন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনিকে বের করা হবে। তারপরে হয়তো সাংবাদিকের সেই মৃতদেহটি ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ি দাফন করা হয়। কোন তদন্তকারী সংস্থা হত্যাকান্ড কে করেছে, তা কখনোই বের করে না। সাংবাদিক হত্যার কোন বিচার এখন পর্যন্ত হয়নি। সাংবাদিক নির্যাতনের কোন মামলায় এখন পর্যন্ত কারো সাজা হয়নি। সংবাদপত্র মালিক এবং সম্পাদক বিশেষ দয়া করে যদি কোন সাংবাদিকের বেতন বৃদ্ধি করে তাহলেই হয়তো সেই সাংবাদিকের বেতন বৃদ্ধি হয়। আইন অনুযায়ি কোন সাংবাদিক বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা পায় না। মানবাধিকার লংঘন হলে বিচার পায় না। সরকার কখনো সংবাদপত্র বা কোন মাধ্যমকে সরকারের আ্ইন, প্রেস কাউন্সিল আইন, সংবাদ কর্মী চাকরী বিধি মানতে বাধ্য করার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি ! মাননীয় তথ্য মন্ত্রী তার এক বক্তব্যে বলেছেন, “সাংবাদিকদের কোন সমস্যা হলে তিনি নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহন করবেন”। তাই মাননীয় তথ্য মন্ত্রীকে বলতে চাই, সাংবাদিক দম্পতির হত্যার বিচার কি করতে পারবেন ? কোন সংবাদপত্র তথ্য মন্ত্রনালয়ের কোন আইন মেনে চলে না, সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদকদের আইন মান্য করতে বাধ্য করাতে পারবেন ? সাংবাদিকতা না করেও সম্পাদক হয়েছেন, তাকে সম্পাদক থেকে সরাতে পারবেন ? সম্পাদকদের দ্বারা সাংবাদিকরা নির্যাতিত হয়, এসব নির্যাতনের কোন বিচার করতে পারবেন ? সংবাদপত্রের সম্পাদকরা আপনার মন্ত্রনালয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি সুবিধা আদায় করছে, এসব তদন্ত করে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারবেন ?
আজ বাংলাদেশে সকল প্রানীর জন্য মানবাধিকার লংঘনের প্রতিকার থাকলেও, সাংবাদিকের মানবাধিকার নাই। আমরা যারা প্রগতিশীল মানসিকতা নিয়ে, সততার সাথে সংবাদ মাধ্যমে কাজ করে, তারা অনেক বেশি নির্যাতিত। গণতন্ত্র আর গণমাধ্যম একটি আরেকটির পরিপূরক। যেখানে গণমাধ্যম যতবেশি শক্তিশালী সেখানে গণতন্ত্রও ততবেশি শক্তিশালী। পরমত সহিষ্ণুতাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় কথা। আলোচনা, মতপ্রকাশ, ঐক্য, সংহতি হলো গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সিঁড়ি। অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা গণতন্ত্রের একটি পূর্ব শর্ত। মৌলিক অধিকার হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। যে সমাজ বা রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই সেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনাও করা যায় না। পৃথিবীর সব সভ্য সমাজ বা রাষ্ট্রে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারে।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের মাথার ওপরে মানহানি, আদালত অবমাননার খড়ক নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া হত্যার হুমকিও বাংলাদেশে কমন বিষয়। গোটা মিডিয়াপাড়া চাপের মুখে আছে। একদিকে সন্ত্রাসী হামলা, হত্যা-নির্যাতন আরেকদিকে দমন-পীড়নের খড়ক। এই দ্বিমুখী চাপে পড়ে গণমাধ্যম স্বাধীনতা হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। গণমাধ্যমকে নানা অভিথায় অভিহিত করা হয়ে থাকে। গণমাধ্যম হলো সমাজের চোখ, দর্পণ। গণমাধ্যম হলো জাতির বিবেক, জনতার কণ্ঠস্বর। গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্থাম্ভ ইত্যাদি নানা নামে গণমাধ্যমকে অভিহিত করা হয়। কিন্তু সেই জাতির বিবেকের ওপর চলে নানান জুলুম-অন্যায় অত্যাচার। গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর করা হয় নির্যাতন, এমনকি তাদরকে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু খুনি ও নির্যাতনকারিরা দায়মুক্ত পাচ্ছে সবসময়। জনগণ, সরকার ও রাজনীতির মধ্যে একটা সেতুবন্ধ রচনাই হলো গণমাধ্যমের কাজ। সেই কাজটি করতে গিয়ে স্বার্থান্বেষী, দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালোভী, দুর্বৃত্তগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ছে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরা।স্বাধীনতায় কেউ কখনও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলে সাংবাদিক সমাজকে রাজনৈতিক মত ও পথ ভুলে গিয়ে পেশাগত দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নির্মল সেনের আহবানে সাড়া দিয়ে সাংবাদিক সমাজ ক্ষমতা, চেয়ার ও হালুয়া-রুটির লোভ ত্যাগ করে রাজনৈতিক বিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে সকল সাংবাদিক সংগঠনকে একটি সাংবাদিক ইউনিয়ন বা সংগঠনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। নইলে দেশে সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন বন্ধ হবে না, নির্যাতনকারিদের দায়মুক্তি অব্যাহত থাকবে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। পেশাগত মর্যাদা আর নিরাপত্তার চেয়ে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও পদ-পদবির লোভ-লালসা বড় হতে পারে না। আর সাংবাদিক সমাজ একজায়গায় একতাবদ্ধ হতে পারলেই কেবল সাগর-রুনির খুনিদের সরকার ধরতে বাধ্য হবে। সব-সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের বিচার আশা করা যাবে তখনই। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাংবাদিকদের পেশাগত ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। স্বদেশে মুক্ত হোক সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *