এই কবর দুটির একটি হালিমার স্বামী দিনমজুর হযরত আলীর (৪৫), আরেকটি তাঁদের পালিত কন্যা আট বছরের আয়েশা আক্তারের। গত শনিবার সকালে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মঘাতী হন হযরত আলী। এত দিন কেউ কোনো কথা না শুনলেও দুটি প্রাণ যাওয়ার পর এখন সবাই হালিমার কথা শুনতে ছুটে আসছেন তাঁর বাড়িতেই। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিরিয়ানি রেঁধে নিহতদের জন্য দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। এখন পুলিশ, শ্রীপুর উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীসহ গণমাধ্যমকর্মীরাও তিন দিন ধরেই এখানে আনাগোনা করছেন। সরকারি সুবিধাগুলো এখন হালিমার ঘরেই চলে আসছে। এ ঘটনায় পুলিশের কোনো অবহেলা আছে কি না, তা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছে জেলা পুলিশ।
এই বাড়ি থেকেই তিন দিন আগে সকালে হযরত আলী তাঁর মেয়েকে ‘নানুবাড়ি’ দেখানোর কথা বলে নিয়ে বের হয়েছিলেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই হালিমা শুনেছেন তাঁদের মৃত্যুর সংবাদ। গতকাল মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল, মাটির ঘরের সামনের দাওয়ায় এখনো ঝুলছে হযরত আলীর লুঙ্গি, আয়েশার জামা-কাপড়।
ঘরের ভেতরে হালিমাকে ঘিরে বসে আছেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে আছেন স্থানীয় নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহমুদা আক্তার, সমাজসেবা অধিদপ্তরের ফিল্ড সুপারভাইজার ফেরদৌসি আক্তারসহ কয়েকজন। ঘরের কাঁচভাঙা আলমারিতে কমলালেবু, পাউরুটি, বিস্কুটসহ নানা পদের খাবার সাজানো। প্রতিবেশীরা জানালেন, হালিমাকে দেখতে আসা সরকারি কর্মকর্তা ও অন্যরা এসব খাবার আনছেন। এক সপ্তাহ আগেও একবেলা মাছ খাওয়ার জন্য এক প্রতিবেশীর কাছে ১০০ টাকা ধার করেছিলেন হযরত আলী। এখন তাঁর বাড়িতে খাবার উপচে পড়ছে।
হালিমা বলেন, তাঁদের মেয়ে আয়েশাকে গাড়িচালক ফারুক হোসেন সাইকেলে তুলে শালবনে নিয়ে গিয়েছিলেন তিন মাস আগে। জোর করে সাইকেলে ওঠালে আয়েশার পা কেটে যায়। মেয়েটার পা পচে গন্ধ বেরিয়েছিল। মেয়ের জন্য বিচার চাইতে প্রথমে স্থানীয় গোসিঙ্গা ইউপি সদস্য আবুল হোসেন ব্যাপারীর কাছে যান হালিমা ও হযরত আলী। ‘পাগল’ বলে ইউপি সদস্য তাঁদের তাড়িয়ে দেন। এরপর হালিমা শ্রীপুর থানায় গিয়েছিলেন। হালিমার অভিযোগ শুনে এলাকায় পুলিশও এসেছিল, কিন্তু আবুল হোসেনসহ অন্যরা পুলিশকে বলেন, ‘এরা সব পাগল, মিথ্যা কথা বলে।’ এরপর তাঁরা পুলিশকে চা-নাশতা খাইয়ে বিদায় করে দেন। ইউপি সদস্য ও পুলিশের কাছে বিচার দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ফারুক হোসেন ও তাঁর লোকজন হযরত আলীর একটি গরু বাড়ির পাশ থেকে জোর করে নিয়ে জবাই করে খেয়ে ফেলেন। বিষয়টি গত ৪ এপ্রিল পুলিশকে লিখিতভাবে জানান হালিমা, কিন্তু পুলিশ কিছুই করেনি।
কান্নায় ভেঙে পড়ে হালিমা বলেন, ‘কেউ আমাদের ফরিয়াদ শোনেনি। …এখন আমি কী নিয়ে থাকব? আপনারা আমারে একটু দেইখা রাইখেন।’
তবে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেন, শিশুটিকে শ্লীলতাহানির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। হালিমা বেগম এর আগে ১৫-২০ বছর শ্রীপুর থানায় বাবুর্চির কাজ করেছেন। তাই থানার প্রায় সবাই তাঁকে ভালোভাবেই চেনেন, খালা বলে ডাকেন। হালিমার অভিযোগ পাওয়ার পর একাধিকবার পুলিশ গিয়ে তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে, শিশুটিকে শ্লীলতাহানি করা হয়নি। তিনি বলেন, আসল ঘটনা হচ্ছে, ওই দম্পতি নিঃসন্তান। তাঁরা প্রায় দুই বিঘা খাসজমির ওপর বসবাস করেন। গ্রামের একটা চক্র চাইছিল তাঁদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করতে। এ জন্য তারা শিশুটিকে স্কুলে যাতায়াতের সময় বিরক্ত করত।
গত সোমবার এই বাড়িতে এসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বাবা-মেয়ের মৃত্যুর জন্য বিচারহীনতাকেই দায়ী করে গেছেন। রিয়াজুল হক বলেন, এ ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন হালিমার পক্ষ থেকে আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে। এ সময় তিনি হালিমার নিরাপত্তাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এ সময় শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আক্তার হালিমার হাতে তাঁর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিয়ে বলেন, শিগগির হালিমার জন্য বিভিন্ন ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। গতকাল হালিমার বিধবা ভাতার ফরম পূরণ করে এনেছেন সমাজসেবা কর্মকর্তারা।
ইউপি সদস্য রিমান্ডে
বাবা ও মেয়েকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা রেলওয়ে থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ফারুক হোসেন (৩০), আবদুল খালেক (৪০), বোরহানউদ্দীন (৩৫), আবদুল হামিদ (৫০), মো. সাহিদ (৪৫), ফাইজুদ্দীন (৩৫) ও ইউপি সদস্য আবুল হোসেন ব্যাপারীকে আসামি করা হয়। তাঁদের মধ্যে শুধু আবুল হোসেন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবুল হোসেনকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত।