স্টাফ রিপোর্টার,ঝিনাইদহঃ
গ্রীষ্মের আগুন গরমে শরীরে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে তাল পাখার জুড়ি নেই। আর এই তালপাখা তৈরির জন্য দেশের বেশ কিছু এলাকা বিশেষ ভাবে সুপরিচিত। তারই একটি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা। এখানে গরমের শুরুতেই পাখা পল্লীর কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়েছে কয়েকগুণ। পাখা ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক আর ঘরে ঘরে কারিগরদের কাজে এই উপজেলার দুই গ্রামের প্রায় দেড় শতাধিক পরিবারে এখন ভীষণ গরম হাওয়া বইছে। সরেজমিন কালীগঞ্জ উপজেলার কোলা ইউনিয়নের পারিয়াট ও রায়গ্রাম ইউনিয়নের দুলালমুন্দিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, কেউ পাতা কেটে সাইজ করছে, কেউ সেলাই করছে, কেউ সুতা ও বাঁশের শলাতে রং করছে। কেউ পাখার বোঝা বাধছে। আবার কেউ পাইকারী ক্রেতাদের সাথে বকেয়া হিসেব ও আপ্যায়নে ব্যস্ত। কাজের ব্যস্ততায় শরীর ঘেমে মাটিতে পড়লেও নিজেদের তৈরি তাল পাখার বাতাস নেওয়ার সময় তাদের নেই।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের পাখা পল্লী খ্যাত দুলালমুন্দিয়া ও পারিয়াট গ্রামে বর্তমান এ অবস্থা বিরাজ করছে। দুলালমুন্দিয়া গ্রামের মজনু, ফজলু,রহমত,বিল্লাল, গফুর, মান্নান, জিন্নাত, চাঁন মিয়া,নুর আলী, আব্দুল বারিক, মোস্তফা ও আব্দুর রহিম সাথে। তারা জানায়, তাদের পূর্ব পুরুষেরা এই পাখা তৈরীর কাজ করতেন। পূর্ব পুরুষদের পেশাটাকে ধরে রাখার জন্য এখনো তারা পাখা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। কালীগঞ্জের দুলালমুন্দিয়ার ৫০টি পরিবার ও পারিয়াট গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার তাল পাখা তৈর করে জীবন জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে।
জন্মগতভাবে এ পেশাটাকে পেয়ে থাকে বলেই তাদের ছেলেমেয়েরাও বিভিন্ন নকশার পাখা তৈরীতে পারদর্শী। পাখা কারিগর জানায়, হাত পাখার তৈরীর প্রধান উপকরণ তাল পাতা এই এলাকাতে পাওয়া যায় না। শীত মৌসূমে নড়াইল, মাগুরা, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে চারা গাছের পাতা কিনে আনেন তারা। তারপর পাতা রোদে শুকিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। পরে পানি থেকে উঠিয়ে নরম ভেজা পাতা গোলাকার করে কেটে মাঝখান থেকে দুঃখ করেন। এরপর বোঝা বেধে পাতা ঘরে রেখে দেন। পরে আবার তা পানিতে ভিজিয়ে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখেন এবং সেখান থেকে নিয়ে সারাবছর বাড়ীতে বসে তালপাখা তৈরী করেন। একটি তাল পাতা থেকে দুটি তালপাখা তৈরী হয়।
তিনি আরও জানান, পুঁজি না থাকায় এবং অনেক দূর থেকে পাতা কেনার কারণে পরিবহনে অনেক বেশি খরচ পড়ে যায়। কারিগর মজনু মিয়া জানান, বছরে ২/৩ মাস তাল পাখার বেশী চাহিদা থাকে। চৈত্র থেকে শুরু করে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যস্ত বিক্রির মৌসূম হলেও চৈত্র ও বৈশাখ মাসই পাখা বিক্রির উপযুক্ত সময়। প্রচন্ড তাপদাহ ও বিদ্যুতের লোডশেডিং এ সময়টাতে বেশী হওয়ার কারণে এসময়টাতে তাল পাখার কাটতি বেশী হয়ে থাকে। ফলে এ সময় তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বছরের অন্যান্য মাসে তালপাখার তৈরীর কাজ ও বিক্রি চললেও শীত আসলে বিক্রি বন্ধ। তাই তারা শীতের আগমনকে ভয় পায়।
তিনি জানান, পরিবারের ছোটরাও বাবা মায়েদের ব্যস্ততা দেখে বসে থাকতে পারে না। পড়াশুনার পাশাপাশি পাখা তৈরীর বিভিন্ন কাজ করে তারা বড়দের সাহায্য করে। নুর আলী নামের একজন কারিগর জানান, গত বছর গুলোর চেয়ে এবছর একটি পাখাতে দাম বেড়েছে প্রায় ৩ টাকা। কিন্তু লাভ হচ্ছে কম। কারণ প্রতিটি জিনিসেরই দাম বেশী। তিনি জানান, প্রতিটি পাখায় তৈরি পর্যন্ত প্রায় ৮ থেকে ১০ টাকা খরচ হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১২ থেকে ১৫ টাকা টাকা। অবশ্য পাইকার ব্যবসায়ীরা উপরোক্ত দামে পাখাগুলি তাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। তারা একটি পাখা ১৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করে। অবশ্য খুব গরমের মধ্যে হাত পাখার চাহিদা বেশি হওয়ায় সে সময় একটি পাখা তারা ২৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি করে।
পারিয়াট গ্রামের সলেমত মালিথার ছেলে আব্দুর রাজ্জাক জানান, তাদের পরিবার ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে পাখা তৈরির কাজ করছেন। এছাড়া তাদের গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার পাখা তৈরির সাথে জড়িত। ওইসব বাড়ির স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র সন্তানরা লেখাপড়ার পাশাপাশি পাখা তৈরি কাজ করেন। তার পরিবারে তিন জন (স্ত্রী, পিতা ও নিজে) পাখা তৈরির কাজ করেন।তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম জানান, পাখা তৈরি করতে রং,সুতা, বাঁশ, কুঞ্চি, তালের পাতার প্রয়োজন হয়। একটি তালের পাতা ৫ টাকা দরে তারা ক্রয় করে থাকেন। আর যারা পাখা সেলাইয়ের কাজ করেন তারা পাখা প্রতি ১ টাকা করে পান। যারা ১০০ জাড়াসোলার কাজ করে তারা ১০ টাকা পান।
সব মিলিয়ে একটি পাখা তৈরি করতে ৮ টাকা বেশি খরচ হয়। বিক্রি করেন ১০ থেকে ১২ টাকায়। একজন কারিগর প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ টি তালপাখা তৈরী করতে পারেন। ফলে প্রতিটি কারিগর বিক্রির মৌসূমে দিনে যাবতীয় খরচবাদে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করতে পারেন। পাইকাররা এখন বাড়ী থেকেই পাখা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে পরিবহন খরচ থেকে রেহাই পাচ্ছেন। বর্তমানে তাদের তৈরি করা পাখা ঝিনাইদহ জেলা ছাড়াও এখন চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, আলমডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। তাদের গ্রামে আইনাল, মিন্টু, আমজাদ, ঝন্টু, সাহেব আলী, বাদশা, আব্বাস, আইজলী, মাসুদ, ইব্রাহীম বিশ্বাসের পরিবার ছাড়া প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার পাখা তৈরির সাথে জড়িত।
আব্দুর রাজ্জাক জানান, তাদের পুঁজি কম। তাই অল্প পুঁজি নিয়ে এ পেশা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকার যদি পাখা কারিগরদের বিনামূল্যে ঋণের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে এ শিল্পকে ধরা রাখা যেত।জোছনা নামের এক গৃহবধু জানান, তালপাতা দিয়ে পাখা তৈরী করে, শরীর ঘেমে মাটিতে পড়লেও বাতাস নেওয়ার সময় তাদের হয় না। কারণ রান্নবান্না ও গৃহস্থলীর কাজের পাশাপাশি তাদেরকে পাখা তৈরীর কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ছাদেকুর রহমান জানান, পাখা পল্লীতে আমরা একটি প্রোগ্রাম করবো। আমাদের সরকারি যেসব ডিপারমেন্ট আছে সেই সব কর্মকর্তাদের সাথে নিয়েই আগামী সপ্তাহে একটি প্রোগ্রাম করা হবে। এ শিল্প কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং যারা এ পেশার সাথে জড়িত তাদের পরিবারের উন্নয়ন করার জন্য সাধ্য মত চেষ্টা করা হবে।