ভারতের প্রধানমন্ত্রী আবারও সেদেশ থেকে তিন তালাক প্রথা বিলুপ্তির প্রসঙ্গ তুলেছেন।
শনিবার একটি অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন যে তিন তালাকের হাত থেকে মুসলমান নারীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য ওই সমাজের মধ্যে থেকেই কিছু শক্তিশালী ব্যক্তি সামনে এগিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা করেন।
তিন তালাকের ইস্যুটিকে তিনি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখারও আহবান জানিয়েছেন। তার এই সর্বশেষ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মুসলমান সমাজ থেকে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া এসেছে। আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তিন তালাক ইস্যুকে রাজনীতির বাইরে রাখার কথা বললেও মি. মোদি এবং তার দল এটাকে নিজের রাজনৈতিক লাভের জন্যই ব্যবহার করছে।
ভারত সরকার যে মুসলমানদের তিন তালাক প্রথা বিলোপ করতে চায়, তা কিছুদিন আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে আইন কমিশনকে জানিয়েছে তারা। ক্ষমতাসীন বি জে পির নেতারাও বারে বারে এই প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন। এরকমই একটা সময়ে তিন তালাকের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময়ে তিনি বলেছেন, “তিন তালাক নিয়ে এত বড় বিতর্ক চলছে এখন। ভারতের পুরনো পরম্পরা দেখে আমার একটা উপলব্ধি হয়েছে যে সমাজের মধ্যে থেকেই এমন শক্তিশালী মানুষের জন্ম হয়, যারা পুরনো প্রথাগুলো ভেঙে দিয়ে আধুনিক ব্যবস্থার প্রচলন ঘটান।”
“মুসলমান সমাজেও এধরনের মানুষ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন যারা মুসলমান মা বোনেদের ওপরে যা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে তারা নিজেরাই লড়াই করবেন এবং কোনও না কোনও সময়ে রাস্তা বের হবেই,” বলেন তিনি।
মি. মোদির এই বক্তব্যের পরে মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকেই দু’ধরণের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের প্রধান ইমাম নুরুর রহমান বরকতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “মি. মোদির উচিত ভালবাসার সঙ্গে কোরান পড়া, ঘৃণা নিয়ে পড়লে হবে না। তাহলেই তিনি বুঝতে পারবেন যে কোরান কেউ বদলাতে পারে না, কোরান তৈরিই হয়েছিল পৃথিবী বদলাতে। আর মুসলমানদের ব্যাপারে মি. মোদী কেন নাক গলাচ্ছেন?”তিনি সরকারটা ভাল করে চালান না! মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করুন, চাকরি দিন! শরিয়তের ব্যাপারটা মুসলমানদের ওপরেই ছেড়ে দিন,” বলেন তিনি।
অন্যদিকে, মুসলমান নারীদের যে সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে তিন তালাক প্রথা বিলোপের দাবীতে সরব, সেই ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের প্রধান জাকিয়া সোমান জানালেন, “আজ যেটা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সেই কথাটাই অনেক দিন ধরে আমরা বলে আসছি যে শিক্ষিত মুসলমানরা, সমাজের আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এগিয়ে আসুন তিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে।” যেভাবে প্রধানমন্ত্রী আশা ব্যক্ত করেছেন যে মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ এগিয়ে আসবেন তিন তালাক প্রথার বিরুদ্ধে, সকলেই সেই একই আশা করছে। আর ইতিমধ্যেই আমরা তিন তালাক বিলোপের দাবীর পক্ষে প্রচুর সমর্থনও পাচ্ছি, যাদের মধ্যে বহু মুসলিম নারী রয়েছেন,” বলেন তিনি।
মি. মোদি তার ভাষণে এটাও বলেন যে তিন তালাক প্রথাকে রাজনীতির চোখ দিয়ে না দেখতে। কিন্তু ঘটনাচক্রে তার দল বি জে পি দীর্ঘদিন ধরেই তিন তালাক আর অভিন্ন দেওয়ানী বিধি প্রচলনের প্রসঙ্গটা রাজনৈতিক দাবী হিসাবে তুলে ধরেছে। এমনকি সদ্য-সমাপ্ত উত্তর প্রদেশ নির্বাচনেও তিন তালাক তুলে দেওয়ার পক্ষে কথা বলেছেন দলের নেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আশিস ঘোষ বলেন, “নরেন্দ্র মোদি যতই বলুন, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি বা তিন তালাক নিঃসন্দেহে একটা রাজনৈতিক ইস্যু। তার দল এবং আর এস এস এটাকে নিজেরাই ব্যবহার করেছে, এখনও করছে।” তিনি বলেন, “সম্প্রতি উত্তর প্রদেশ নির্বাচনেও এটা একটা রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে তারাই তুলে এনেছিল। আসলে তারা মুসলমান সমাজের মধ্যে একটা বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা করছে। উত্তর প্রদেশে একজনও মুসলমান প্রার্থী না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে অনেক মুসলমান প্রধান এলাকায় তারা জিতেছে, তাদের নিজেদের স্ট্র্যাটেজিস্টদের মতেই তিন তালাক ইস্যুর কারণে সেটা সম্ভব হয়েছে। অনেক মুসলমান নারী তাদের ভোট দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, এই প্রচেষ্টা আরও বাড়বে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে।
একদিকে যেমন বিজেপি বা কিছু মুসলিম মহিলা সংগঠন তিন তালাকের বিরুদ্ধে সরব, তেমনই ভারতের মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডও এই প্রথা বিলোপের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহ করছে।
সুত্রঃ বিবিসি বাংলা