অপহরণের ২৪ দিন পর মায়ের কোলে সুমাইয়া

Slider জাতীয়

63306_f3

 

ঢাকা; সন্তানকে খুঁজে পেতে সব চেষ্টাই যেন ব্যর্থ হতে যাচ্ছিল। দীর্ঘ ২৪ দিন কেটেছে তাদের নির্ঘুম রাত। নাওয়া-খাওয়া ভুলে মেয়েকে পেতে ছুটেছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। অবশেষে ২৪ দিন পর মা-বাবার কোলে ফিরেছে অপহৃত সুমাইয়া। পুলিশের চেষ্টায় তাকে ফিরে পেয়ে আনন্দের অশ্রু সুমাইয়ার  মা-বাবার চোখে। সুমাইয়াকে ফিরে পেয়ে মা মুন্নী বেগম চোখের পানি মুছতে মুছতে মেয়েকে চুমু দিচ্ছিলেন। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বড়গ্রামের বাসার সামনে থেকে অপহৃত হয় সুমাইয়া। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বুধবার রাতে কদমতলী থানার রহমতবাগ দক্ষিণ দনিয়ার কামালের বাড়ি থেকে সুমাইয়াকে উদ্ধার করে কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশ। এ ঘটনায় সাবিনা আক্তার বৃষ্টি ও তার পিতা সিরাজ মিয়া নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ৩রা এপ্রিল বিকালে বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয় পাঁচ বছরের শিশু সুমাইয়া। খোঁজ করা হয় বাসার আশপাশ থেকে প্রতিবেশী, স্বজনদের বাসায়। কোথাও তার কোনো সন্ধান না পেয়ে পরদিন কামরাঙ্গীরচর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন সুমাইয়ার পিতা জাকির হোসেন। শিশু নিখোঁজের এই বার্তা প্রেরণ করা হয় দেশের প্রতিটি থানায়। কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশের তৎপরতা চলতে থাকে। এরমধ্যেই প্রতিবেশী এক আইনজীবীর বাসার সামনের সিসি টিভির ফুটেজ উদ্ধার করে পুলিশ। সিসি টিভির ফুটেজে পাওয়া যায় অপহৃত হওয়ার দৃশ্যটি। বোরকা পরা এক নারী হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে সুমাইয়াকে। ভিডিও ফুটেজ দেখে ওই নারীকে শনাক্ত করেন সুমাইয়ার মা-বাবা। ওই নারীর নাম সাবিনা আক্তার বৃষ্টি। একসময় তাদের বাসার পাশেই ভাড়া থাকতো। এরচেয়ে বেশি কিছুই জানেন না। ঘটনার দিন বৃষ্টি এসেছিলো সুমাইয়াদের বাসায়। ভিডিও ফুটেজ দেখার পরই ২৪শে এপ্রিল কামরাঙ্গীরচর থানায় মামলা করেন শিশু সুমাইয়ার পিতা জাকির হোসেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, ঘটনার সময়ে বাসায় বৃষ্টি নামের এক মহিলা আসে। যার ঠিকানা জানেন না। বৃষ্টি এসে বাড়ির মালিকের খোঁজখবর জানতে চায়। তখন বাড়ির মালিক বাইরে ছিলেন। সুমাইয়ার মা মুন্নী বেগম ঘরে ছিলেন। বাসার সামনে বারান্দায় খেলছিলো সুমাইয়া। কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বের হয়ে মুন্নী দেখেন সুমাইয়া নেই, বৃষ্টিও নেই। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে প্রায় ছয় মাস আগে এখানে ভাড়া থাকতো বৃষ্টি।
বৃষ্টির সম্পূর্ণ ঠিকানা না থাকায় বেশ বেগ পেতে হয় পুলিশকে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান মানবজমিনকে বলেন, বৃষ্টির অবস্থান নিশ্চিত হতে বেগ পেতে হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে বৃষ্টির অবস্থান নিশ্চিত হয়ে বুধবার রাতে অভিযান চালিয়ে বৃষ্টি ও তার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসময় আরো তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
উদ্ধারের পর গতকাল সকালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে প্রেস ব্রিফিং করেন লালবাগ বিভাগের  উপ-পুলিশ কমিশনার ইব্রাহিম খান। এসময় উদ্ধার হওয়া শিশু সুমাইয়া ও তার মা-বাবা উপস্থিত ছিলেন। মা-বাবার কোল থেকে নেমে মিডিয়া সেন্টারের বারান্দাজুড়ে হাঁটছিলো সুমাইয়া। সুমাইয়া বলেছে, ‘ওইদিন বৃষ্টি আমাদের বাসায় এলো। মা ঘরে ছিলো। আমি বাইরে খেলা করছিলাম। বললো, তোমাকে চিফস কিনে দেব। চলো। তারপর হাত ধরে নিয়ে গেল। বৃষ্টি আগেও আমাদের বাসায় এসেছে।’ প্রায়ই সুমাইয়াকে তার বাসায় নিতে চাইতো বৃষ্টি- জানিয়ে সুমাইয়া বলে, ‘চিফস কিনে দেয়ার কথা বলে দূরে নিয়ে যাচ্ছিলো।’ তখন চিৎকার করলে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সুমাইয়া বলে, ‘চিৎকার করতে পারিনি। আমাকে রিকশায় তুলে মুখ চেপে ধরে রেখেছিলো।’ সুমাইয়া জানিয়েছে, বৃষ্টি ও তার স্বামী রুমে বসে ধূমপান করতো। বারবার পাশের দোকান থেকে সুমাইয়াকে দিয়ে সিগারেট আনাতো। বাসায় মা-বাবার কাছে ফেরার জন্য প্রায়ই কান্না করতো সুমাইয়া। কিন্তু মা-বাবার কথা বললেই তাকে মারধর করতো বৃষ্টি।
সাবিনা আক্তার বৃষ্টি সম্পর্কে জানা গেছে, সিরাজ মিয়ার দুই মেয়ের মধ্যে বৃষ্টি বড়। তার স্বামীর নাম কাজল। পুরো পরিবারটি নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত। জিজ্ঞাসাবাদে বৃষ্টি পুলিশকে জানিয়েছে, পাঁচ বছর আগে বৃষ্টিকে পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে দেয় তার মা। দীর্ঘদিন সে কক্সবাজারে ছিল। একইভাবে তার ছোটবোনকে একটি পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে দেয়। তার মাও একই পেশায় জড়িত। এছাড়াও বৃষ্টি ও তার স্বামী কাজল বংশাল, কদমতলি এলাকায় মাদক ব্যবসা করছে দীর্ঘদিন থেকে। বর্তমানে মাদক মামলায় কারাগারে রয়েছে কাজল। বৃষ্টি এ পর্যন্ত চার বার ভারতে গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে শক্তিশালী কোনো অপহরণকারী চক্রের সদস্য সে। শিশু সুমাইয়াকে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে বা অন্য কি উদ্দেশ্যে অপহরণ করেছিলো এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীন ফকির মানবজমিনকে বলেন, সাবিনা আক্তার বৃষ্টি ও তার বাবা সিরাজ মিয়াকে তিন দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। বৃষ্টি কোনো অপহরণকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত কি-না, তার সঙ্গে আর কারা জড়িত এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বৃষ্টি সম্পর্কে ওসি বলেন, তাদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। বংশাল, কদমতলি এলাকাতেই বড় হয়েছে। অন্যদিকে, অপহৃত শিশু সুমাইয়ার পিতা জাকির হোসেন জানান, তাদের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা থানার  পূর্ব কলাপাড়া গ্রামে। তিনি একটি স্টিলের কারখানায় চাকরি করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *