যেটুকু ধান তুলতে পেরেছে হাওর এলাকার কৃষক, রোদের অভাবে তা-ও শুকাতে পারছে না। স্তূপ করে রাখা সেই ধান পচতে শুরু করেছে। চারা গজিয়ে যাওয়া ধান দেখাচ্ছে হুমাইপুর হাওরের এক কৃষক।
হাওরাঞ্চলের পর এবার ডুবছে চলনবিলের বোরো ধানের ক্ষেত। ইতিমধ্যে নিম্নাঞ্চলের কোনো কোনো জমির ধান পুরোপুরি তলিয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেতে ধানের শীষগুলো কোনোক্রমে পানির ওপরে জেগে আছে। এ অবস্থায় আধাপাকা ধানই কোনোক্রমে কেটে নিতে ব্যস্ত সময় পার করছে নাটোরের চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। কোথাও কোথাও নৌকায় আবার কোথাও হাঁটুপানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আধাপাকা ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক-শ্রমিকরা। পুরো জনপদে সবার চোখেমুখে এখন পানিতে ডুবে ফসল হারানোর শঙ্কার ছায়া। গতকাল বুধবার সরেজমিনে এলাকায় ঘুরে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে।
জমির আইলে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন কাউয়াটিকরী গ্রামের কৃষক রুবেল। তাঁর সাত বিঘা জমির বোরোক্ষেতে ধানের শীষটুকু শুধু জেগে আছে। মণপ্রতি ১২ কেজি ধান দেওয়ার শর্তে শ্রমিক লাগিয়েছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি জানান, হঠাৎ করেই গত সোমবার চলনবিলের ব্যাসানী খাল দিয়ে এই এলাকার অনেক জমিতে পানি ঢুকে পড়ে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এসব গ্রামের নিম্নাঞ্চলে বোরো ধানক্ষেত তলিয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে অনেক জমির ধান পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেতে ধানের শীষ জেগে থাকলেও বাকিটা পানির নিচে। যে জমিতে বিঘাপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ মণ ধান আশা করছিলেন এখন সেখানে ১০ থেকে ১২ মণ ধান পাবেন কি না তা নিয়েই তিনি সন্দিহান।
কাউয়াটিকরী গ্রামের দুলাল হোসেন জানান, আগাম জাতের কিছু ধান কাটলেও বাকি জমির ধান তলিয়ে যাওয়ায় আধাপাকা ধানই কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শ্রমিক না পাওয়ায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে। কালিনগর গ্রামের গণি মিয়া জানান, তিনি ৫০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা চুক্তিতে ধান কাটা শ্রমিক নিয়োগ করেছেন। এমনিতেই আধাপাকা ধান কাটতে হচ্ছে, তার ওপর এত টাকায় শ্রমিক নিয়োগ করে তাঁর কিছুই থাকবে না।
সিংড়া উপজেলার বেড়াবাড়ী, কাউয়াটিকরী, নুরপুর, আনন্দনগর, কৃষ্ণনগর, কালিনগর, গুরুদাসপুর উপজেলার বিলহরিবাড়ী, সাপগাড়ী, বিলসা, রুহাই ও পিপলা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার নিম্নাঞ্চলের বেশির ভাগ গ্রামের বোরো ধান, ভুট্টা, বাদাম ইত্যাদি ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষকরা শ্রমিকের অভাবে ধান কাটতে পারছে না। তাই অন্য এলাকা থেকে বেশি দামে শ্রমিক এনে ধান ঘরে তোলার চেষ্টা চলছে।
বেড়াবাড়ী গ্রামে দেখা যায়, বেশির ভাগ মানুষ প্রায় কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে ডুবে যাওয়া ধান কাটার চেষ্টা করছে। অনেকেই কাটা ধান নৌকাযোগে পারে আনছে। পাটকোল গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক জানান, এক দিনের বানের পানির কারণে তাঁর ১১ বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। প্রতিবিঘা জমিতে আট থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হলেও এক টাকার ধানও ঘরে তুলতে পারেননি তিনি।
আনন্দনগর গ্রামের শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে বছর তিনেক আগে আনন্দনগর খালের ওপর একটি স্লুইস গেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা আর এগোয়নি। এটি নির্মিত হলে বিলের পানি নিয়ন্ত্রণ করে ফসলের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হতো।
কৃষ্ণনগর গ্রামের কৃষক আবু সাইদ ও মজিবর রহমান বলেন, ‘৩২ বছর পর চলনবিলে এমন দুর্যোগ নেমে এলো। হঠাৎ এই দুর্যোগের কারণে আমরা কৃষকরা দিশাহারা। অনেকেই কাঁচা ধান কাটছে। কিন্তু তাতে তেমন একটা লাভ হবে না। ’
ডাহিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ জানান, গত কয়েক দিনের বর্ষণে উত্তরাঞ্চলের ঢলের পানি আত্রাই নদী হয়ে বিভিন্ন খাল দিয়ে চলনবিলে ঢুকে পড়ায় এভাবে ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে চলনবিলের বেশির ভাগ অঞ্চলের ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, টানা কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টিতে সিংড়া উপজেলার আত্রাই ও গুড় নদীতে পানিপ্রবাহ অনেক বেড়ে গেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় জোড় মল্লিকা, নিংগইন ও পাটকোল ব্রিজের নিচ দিয়ে চলনবিলে প্রতিনিয়ত পানি প্রবেশ করছে। এতে নিংগইন, বালুভরা, হাঁসপুকুরিয়া, শেরকোল, তেলীগ্রাম, ভাগনাগরকান্দি মাঠের বোরো ধান ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে উপজেলার নুরপুর, ভাগনাগরকান্দিসহ বেশ কিছু এলাকায় তলিয়ে গেছে বোরো ধান। কৃষকরা তড়িঘড়ি করে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে সেসব ধান কেটে নিচ্ছে।
নিংগইন এলাকার কৃষক আলহাজ আশকান আলী ও জব্বার আলী বলেন, চলনবিলে বছরে একটিমাত্র ফসল এই বোরো ধান। এই আবাদ হারিয়ে গেলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
এদিকে নদীর পানি যাতে বিলে ঢুকতে না পারে সে জন্য গত সোমবার সকালে জোড় মল্লিকা, নিংগইন ও পাটকোল এলাকায় জরুরিভাবে মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। এলাকাবাসী মাইকিং করে বাঁধ নির্মাণে অংশগ্রহণের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানায়। পরে এলাকাবাসীর সম্মিলিত অংশগ্রহণে ইতিমধ্যে বাঁধগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
সিংড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা এ বিষয়ে বলেন, বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে চলনবিলে পানি প্রবেশের কারণে কিছু জমির ধান তলিয়ে গেছে। যারা এখনো ধান ঘরে তুলতে পারেনি তাদের ধান কাটার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এবার চলনবিলে ৩৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ছয় হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ নাজমুল আহসান বলেন, উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি মাঠের ফসল তলিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত উপজেলার সাড়ে ৩০০ হেক্টর জমির ধান নিমজ্জিত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, চলনবিলের বিভিন্ন মাঠের ফসল রক্ষার জন্য ব্রিজের নিচে জরুরিভাবে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বখতিয়ারপুরের রেগুলেটর দিয়ে পানি প্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে।
সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, বর্ষণ ও ঢলের পানিতে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ফসল রক্ষায় একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এ বছর চলনবিলের বন্যাকবলিত তিনটি উপজেলায় ৬৪ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। তবে কী পরিমাণ বোরোক্ষেত তলিয়ে গেছে তা নিরূপণ করতে পারেনি কৃষি বিভাগ। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা বেলাল হোসেন জানান, চলতি বোরো মৌসুমে আগাম বর্ষণের কারণে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ধান পাকলেই কৃষকদের আগেভাগে তা কেটে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।