প্রতিবেশ অনুযায়ী সমাধান খুঁজতে হবে

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী সারাদেশ

অনেক বছর আগের কথা। তখন উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস হতো প্রায়ই। ওই সময় আমি একবার লিখেছিলাম,
মাড-স্লিংগিং ইন ফ্লাড ওয়াটার, অর্থাৎ বানের জল নিয়ে কাদা–ছোড়াছুড়ি। এবারের হাওরে বন্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যা-রাজনীতিও শুরু হয়ে গেছে। আমরা না খেয়ে থাকতে পারি, রাজনীতি ছাড়া বাঁচি কেমনে?

বাংলাদেশে যে কয়টি বিশেষ প্রতিবেশ অঞ্চল আছে, তার মধ্যে হাওর একটি। যারা হাওর দেখেনি, তারা বুঝতে পারবে না এটা কেমন। শুকনো মৌসুমে এর এক রূপ, বর্ষাকালে অন্য রকম। সুন্দরবন না দেখলেও বোঝা যায় না যে এটা শুধু গাছপালা বা ঝোপঝাড় নয়, এটা একটা বিশেষ ধরনের ইকোসিস্টেম। তেমনি হাওর অঞ্চলও অন্য ধরনের একটি ইকোসিস্টেম বা প্রতিবেশ অঞ্চল। এখানে মাছ, গাছ, ফসল, বসতি, এমনকি জমির মাপজোখেও বিশেষত্ব আছে।

আমি হাওর বিশেষজ্ঞ নই। তবে পেশাগত কারণে হাওর এলাকা দেখার সুযোগ হয়েছে। এক-দুই দিনের জন্য নয়, আমি সেখানে গিয়েছি অনেকবার, থেকেছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের যেসব এলাকায় হাওরগুলোর অবস্থান, আমি তার সব কটিই দেখেছি, সবখানেই থেকেছি এবং সব ঋতুতেই। সুতরাং, হাওর নিয়ে দু-চার কথা আমি বলতেই পারি।

গ্রাম বলতে আমরা সাধারণত মানববসতি বুঝি। দুটি বা তিনটি গ্রামের মধ্যে যে বিস্তীর্ণ জমি, সেখানে গ্রামের কৃষকেরা চাষাবাদ করেন। দেশের একটা বড় এলাকা হলো প্লাবনভূমি। চাষের জমিগুলো বর্ষার পানিতে ডুবে যায়। এখন বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের কারণে অনেক জমিতে বর্ষার পানি আগের মতো ঢোকে না। তাই বন্যা হয় না। ফলে চাষাবাদের ধরন অনেকটাই বদলে গেছে।

হাওরের অবস্থাটা একটু আলাদা। এখানে গ্রামগুলো অনেক দূরে দূরে। মাঝখানটা খোলা। শুকনো মৌসুমে সেখানে চাষাবাদ হয়। বৈশাখের শেষে পানি আসতে শুরু করে। জমি সব তলিয়ে যায়। গ্রামগুলো অথই পানিতে বিচিত্র দ্বীপের মতো দেখা যায়। তখন হাওরগুলোর মধ্যে কোনো সীমানা থাকে না। যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। নদীর পাড় ডুবে যাওয়ার ফলে নদী আর হাওর একাকার হয়ে যায়। এ অবস্থা থাকে বছরে ছয় মাস। ওই সময় মানুষ ঘরে বন্দী থাকে। কেউ কেউ মাছ ধরেন। কার্তিকের শেষে পানি সরে যেতে শুরু করলে আরম্ভ হয় চাষাবাদের আয়োজন। এই হচ্ছে হাওর-জীবন।

কিছু কিছু জায়গায় সারা বছরই পানি থাকে। এগুলোই হচ্ছে বিল বা জলমহাল। এগুলো মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে সরকার ইজারা দেয়। হাওরের গ্রামগুলোতে অনেক জেলের বসতি। তাঁদের বেশির ভাগ এখন এই ইজারাদারদের শ্রমদাস হিসেবে কাজ করেন। জেলেরা হিন্দু হলে ‘কৈবর্ত’, আর মুসলমান হলে বলে ‘মাইমল’। তাঁদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন খুব বেশি নেই।

হাওর দেখতে অনেকটা বাটি বা থালার মতো। এ রকম হাওর আছে অনেক। ১৯৯০-এর দশকে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানের আওতায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পানি–ব্যবস্থাপনার জন্য যে সমীক্ষা হয়েছিল, তার তথ্য অনুযায়ী হাওর অঞ্চল আছে ছয় হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে, অর্থাৎ ছয় লাখ হেক্টর। ওই সমীক্ষায় পরামর্শক দলের একজন সদস্য হিসেবে আমাকে কিছু তথ্য জোগাড় ও সংকলন করতে হয়েছিল। তখন হাওর অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল ৪৮ লাখ। ধারণা করা হয়েছিল, ২০১৫ সালে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬১ লাখে। ওখানে অবশ্য জনসংখ্যার ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত কম। তো এই ৬১ লাখ বা তার কিছু কম-বেশি মানুষের জীবনে এবার ভয়ানক দুর্যোগ নেমে এসেছে। এ ধরনের বিপর্যয় ঘটলে দুর্গত মানুষের পাশে কীভাবে দাঁড়ানো যায়, সেটা না ভেবে আমরা কল্পনায় শত্রু খুঁজে বেড়াই, গালাগাল দিই, আস্ফালন করি। মুহূর্তেই সরকার খলনায়ক হয়ে যায়। আর ভারতীয় জুজু তো আছেই।

দেশের অন্যান্য এলাকায় বাঁধ বানিয়ে বন্যার পানি ঠেকানো যত সহজ,হাওরে এটা একেবারেই অসম্ভব। হাওর হলো প্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত জলাধার। এটা মেনে নিয়েই আমাদের চিন্তাকে সাজাতে ও পরিকল্পনা বানাতে হবে, দুর্ভোগ কীভাবে কমানো যায়।

হাওরের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। সেটি হলো ডুবো বাঁধ, সাবমার্সিবল এম্ব্যাঙ্কমেন্ট। এই এলাকায় উঁচু বাঁধ তৈরি করে টিকিয়ে রাখা যাবে না। বিস্তর টাকা খরচ করে যদিও–বা স্থায়ী উঁচু বাঁধ বানানো হয়, তাহলে হাওরে প্রতিবেশ আর টিকবে না। সে জন্যই এই ডুবো বাঁধের প্রযুক্তি।

হাওর এলাকা মূলত একফসলি। এখানে বোরো মৌসুমে নানা জাতের ধানের আবাদ হয়। মেঘালয়ে যদি একনাগাড়ে কয়েক দিন বৃষ্টি হয় বা কোনো কারণে উজান থেকে বেশি পানি হঠাৎ চলে আসে, তখনই হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। এই ঝুঁকি কমানোর জন্যই এমন একটা ব্যবস্থা—ডুবো বাঁধ—যাতে করে কয়েক দিনের জন্য বন্যা ঠেকিয়ে রাখা যায় এবং কৃষকেরা তড়িঘড়ি করে ধান কেটে ঘরে নিয়ে যেতে পারেন। তারপর বাঁধ যাবে ডুবে। বন্যার পানি সরে গেলে মাঠ আবার ফসলে হাসবে এবং ওই বাঁধ আবার মেরামত করে পরের বছরের জন্য তৈরি রাখতে হবে। আগাম বন্যার ঝুঁকি থেকে ফসল বাঁচানোর জন্যই ডুবো বাঁধের প্রযুক্তি। আগাম বন্যা না হলে, অর্থাৎ সময়মতো যদি হাওরে পানি ঢোকে, তাহলে ফসলের ক্ষতি হয় না। কৃষক তার আগেই ফসল ঘরে নিয়ে যান।

এবার অবশ্য অন্য রকম হয়েছে। আগামেরও আগাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে হাওর। এরপরও কিছু আধা পাকা, আধা কাঁচা ধান হয়তো ঘরে নেওয়া যেত, যদি বাঁধ ভেঙে কয়েক ঘণ্টায় জমি তলিয়ে না যেত। অর্থাৎ, বাঁধ মেরামতে ত্রুটি ছিল। কেন এমন হলো, এ নিয়ে হয়তো তদন্ত হবে। হয়তো মাঠপর্যায়ের কোনো কোনো কর্মকর্তার চাকরি যাবে বা হয়রানিমূলক বদলি হবে। তারপর সবাই ব্যাপারটা ভুলে যাবেন। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, এখানে মনিটরিংয়ের দুর্বলতা আছে। কাজ ঠিকঠাকমতো হলো কি না, তা দেখা হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত পুরো চেইনটা সঠিকভাবে কার্যকর নেই।

হাওর এলাকায় বেশ কয়েকটি নদী আছে। তার মধ্যে যদুকাটা, সুরমা, কুশিয়ারা, কালনী, কংস, বাউলাই উল্লেখযোগ্য। উজান থেকে যখন পানির ঢল নামে, নদী তা সবটা বয়ে আনতে পারে না। উজান থেকে আসা বালু আর পলি জমে নদীর তলদেশ অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে। তাই নদী উপচে পানি দুকূল ভাসিয়ে দেয়। নদীগুলো আঁকাবাঁকা। পানির প্রবাহ যেটুকু, তা সরতেও সময় লাগে বেশি। সমস্যা সমাধানের উপায় হলো, নদীগুলোর জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে এবং দ্রুত পানি নিঃসরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিকল্পনা বানিয়েছিল, কালনী-কুশিয়ারা নদীতে লুপ কেটে আঁকাবাঁকা অংশটুকু সোজা করে দিতে, যাতে পানি তাড়াতাড়ি ভৈরবের দিকে চলে যায়। এটা একটা সমাধান হতে পারে। হাওরের মধ্যে নদীতে বাঁধ দেওয়ার চিন্তা করা যায় না। নদীর পানির ধারণক্ষমতা বাড়ানোর দিকেও নজর দেওয়া দরকার।

আমাদের দেশে পানি বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। কিন্তু হাওর অঞ্চলের জন্য একটা টেকসই ব্যবস্থা কেন নেওয়া হচ্ছে না, তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। ভেতরের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঠিকমতো বরাদ্দ পাওয়া যায় না, বরাদ্দ পেতে দেরি হয়, ঠিকাদারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে কাজ আদায় করা যায় না ইত্যাদি। কোনো প্রকল্প নেওয়া হলেই সেখানে ঠিকাদার-কর্মকর্তা-রাজনীতিবিদের একটা অশুভ আঁতাত গড়ে ওঠে। এটা ঠেকানোই একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একসময় যা ছিল হাওর উন্নয়ন বোর্ড, তা এখন হয়েছে হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর। এটি একটি ঠুঁটো জগন্নাথ। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।

মাঠপর্যায়ে কাজ করার সময় দেখেছি, অধিকাংশ মানুষ গরিব। অভাবের তাড়নায় তাঁরা কার্তিক মাসে ঋণ নেন, ফসল উঠলে শোধ করেন। ব্যাংকঋণের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ সম্ভবত বেশি। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ঋণ পুনঃ তফসিল করবে। ব্যক্তি পর্যায়ের ঋণের কী হবে, জানি না। এ রকম একেকটা দুর্যোগ আসে। হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অভাবের তাড়নায় জমি বেচেন, ভিটা হারান। তারপর এককাপড়ে শহরে চলে আসেন কাজের খোঁজে। এ রকম দারিদ্র্যকরণ এবং উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া চলছে শত বছর ধরে। এবারের হাওর-বন্যায় এ রকম অনেক মানুষ উদ্বাস্তু হবেন। সরকারের ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’ বা ‘একটি ঘর একটি খামার’ স্লোগান হিসেবেই থেকে যাবে। কেননা, তাঁদের অনেকেরই ফিরে যাওয়ার মতো ঘর থাকবে না।

কয়েক বছর আগে কৃষিমন্ত্রীর মুখে শস্যবিমার কথা শুনেছিলাম। হাওরে এ ধরনের দুর্যোগ প্রতিবছর হয় না। হয়তো ৫ কিংবা ১০ বছরে একবার। শস্যবিমা থাকলে মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেতেন। রিলিফের ভরসায় কি জীবন চলে, মর্যাদা থাকে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *