রাজধানীতে বাস-মিনিবাসের ভাড়ার ক্ষেত্রে অরাজকতা চলছেই। ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকরের তিন দিন পরও একই গন্তব্যে একেক বাসে একেক হারে ভাড়া আদায় চলছে। বাস-মিনিবাস ‘লোকাল’ হয়েছে কেবল সব জায়গায় যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং কিছুটা স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের ক্ষেত্রে। অনেক বাস-মিনিবাস গতকাল মঙ্গলবারও সড়কে না নামায় নগরবাসীর ভোগান্তিও কমেনি।
অবশ্য পরিবহন খাতের নেতারা বলেছেন, তাঁরা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। অচিরেই এই বিশৃঙ্খলা দূর হবে।
গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি স্ট্যান্ডেই বাস-মিনিবাস থামছে, যাত্রী তোলা হচ্ছে। কিন্তু ভাড়া নেওয়া হচ্ছে সিটিং সার্ভিসের মতো। এ নিয়ে ভাড়া আদায়কারী ও বাসচালকের সহকারীদের সঙ্গে যাত্রীদের বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। কখনো কখনো তা হাতাহাতিতেও গড়াচ্ছে। আবার সব পরিবহনের বাস সব স্ট্যান্ডে থামছে না।
বাস-মিনিবাসের ভাড়ার হার কেমন, তা পর্যবেক্ষণ করতে বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড়ে বিভিন্ন বাস-মিনিবাসে খোঁজ নেওয়া হয়। ঢাকার উত্তর দিকের বিভিন্ন গন্তব্য থেকে আসা প্রায় সব পরিবহনের বাসগুলোই পুরানা পল্টন-গুলিস্তান হয়ে মতিঝিল এবং সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, চিটাগাং রোড, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জে যায়। সাধারণ গন্তব্য হিসেবে গুলিস্তানকে ধরে যাচাই করা হয়েছে ভাড়ার হার। দেখা গেছে, শাহবাগ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১০ টাকা থেকে নিম্নে ৫ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
শাহবাগে বারডেম হাসপাতালের পাশে দিনের বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে ১০ থেকে ১৫টি বাস-মিনিবাস দেখা যায়। প্রতিনিয়ত বাস যায়, আসে। কিন্তু গতকাল সংখ্যা ছিল খুব কম। একই সময়ে মাত্র দু-তিনটি বাস-মিনিবাস দেখা গেছে। সেখানে ১৫টি পরিবহনের অন্তত অর্ধশত বাস-মিনিবাসে গুলিস্তানের ভাড়া জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, একেকটির একেক ভাড়া। তানজিল পরিবহনের ভাড়া গুলিস্তান ১০ টাকা। ওয়েলকাম ও দিশারী পরিবহনের গুলিস্তানের ভাড়া ১০ টাকা। মেশকাত পরিবহনে মতিঝিলের ভাড়া ১০ টাকা। সাবেক ৮ নম্বর রুটের (গাবতলী-যাত্রাবাড়ী) বাসে পল্টন, মতিঝিল পর্যন্ত ১০ টাকা। এভারেস্ট, ল্যামস ও মা পরিবহনে গুলিস্তানের ভাড়া ৮ টাকা। হিমাচল ও লোপা-মরিয়া পরিবহনে গুলিস্তানের ভাড়া ৭ টাকা। এ ছাড়া বিআরটিসির ডবল ডেকার, ইটিসি, ইউনাইটেড, বিহঙ্গ এবং গাবতলী লিংক পরিবহনে শাহবাগ থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ৫ টাকা।
একইভাবে দেখা গেছে, সায়েদাবাদ বা চিটাগাং রোড, কেরানীগঞ্জ—এসব পথেও একেক পরিবহনে একেক রকম ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সায়েদাবাদের ভাড়া ১০ থেকে ২০ টাকা, চিটাগাং রোডের ভাড়া ২০ থেকে ২৫ ও ৩০ টাকা, নারায়ণগঞ্জের ভাড়া ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা, কেরানীগঞ্জের ভাড়া (বুড়িগঙ্গা সেতুর এ পাড়ে) ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। মিরপুর ১ থেকে বাড্ডা নতুন বাজার পর্যন্ত চলাচল করে জাবাল এ নূর পরিবহনের বাসগুলো। সিটিংয়ের সময় ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। এই পথের নির্ধারিত ভাড়া ১৫ টাকা। ভাড়ার এই তালিকা বাসের জানালায় টাঙানো আছে। কিন্তু আগের হারেই ২৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
কেরানীগঞ্জ থেকে প্রৌঢ় আবুল বাসার স্ত্রী মরিয়ম বেগমের সঙ্গে বারডেম হাসপাতালে এসেছিলেন রক্ত ও অন্যান্য পরীক্ষা করাতে। প্রতি মাসে অন্তত একবার তাঁকে এখানে আসতে হয়। গতকাল পরীক্ষা শেষে আধা ঘণ্টা ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কেরানীগঞ্জের বাস পাচ্ছিলেন না। গুলিস্তান যেতে পারলে সেখান থেকে লেগুনাতেও কেরানীগঞ্জ যাওয়া যায়। কিন্তু বাসের অপেক্ষায় অনেক মানুষ। বাস আসতেই সবাই ওঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তিনি বললেন, দুবার স্ট্রোক করায় তিনি জোরে হাঁটতেই পারেন না। অন্যদের মতো ছুটে, ধাক্কাধাক্কি করে বাসে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ছোটখাটো ব্যবসা আছে। তাই আয়ও অল্প। এ কারণে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাওয়া তাঁর জন্য বেশি খরচ।
নগরের সর্বত্র বাসের সংকটে যাত্রী ভোগান্তির চিত্র ছিল মোটামুটি এ রকমই।
শাহবাগ থেকে কচুক্ষেতের লোকাল ভাড়া ১৫ টাকা। কিন্তু ওই পথে চলাচলকারী বাসে সিটিংয়ের হারে ২০ টাকা নেওয়া হচ্ছিল। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে বলে জানালেন ওই বাসের টিকিট বিক্রেতা বেলাল হোসেন। অন্যান্য বাসের কর্মীদের সঙ্গেও ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের বাদানুবাদের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে গতকাল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত ছিল। নগরের পাঁচটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত মোট ১৪০টি মামলা করেন। এ সময় ৪ লাখ ৩৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং দুজন চালককে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বাসভাড়ার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘এই বিশৃঙ্খলা বহু বছর থেকে চলে আসছে। এক দিন, দুই দিনে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। জনগণের মঙ্গলের জন্যই আমরা একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছি। সাময়িকভাবে কিছু অসুবিধা হচ্ছে। তবে অচিরেই এই সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠব। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সময় বাস চলাচল সব সময়ই কমে যায়। এবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের সঙ্গে পরিবহন সমিতি সহায়তা করায় চলাচল আরও কমে গেছে। কাল (আজ বুধবার) বিকেল চারটায় বিআরটিএর চেয়ারম্যান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে সভা ডেকেছেন। আমরা সেখানে আলোচনা করে একটা সমাধানের উপায় করতে পারব বলে আশা করি।’