বিইআরসির সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে পাইকারি বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ (৭২ পয়সা) বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আর বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানি খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে ৮ থেকে ১২ শতাংশ হারে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
এর আগে ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে পাইকারি পর্যায়ে ছয়বার এবং খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এখন দেশে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদনমূল্য ৫ টাকা ৫৯ পয়সা। এর সঙ্গে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় যুক্ত করে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গড় দাম পড়ে ৬ টাকা ৭৩ পয়সা। কোম্পানিগুলোর দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়ানো হলে প্রতি ইউনিটের গড় দাম হবে প্রায় ৭ টাকা ৭১ পয়সা।
বিদ্যুতের দাম ছাড়াও দু-একটি বিতরণ কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে ডিমান্ড চার্জ ও সার্ভিস চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বলে বিইআরসির সূত্র জানায়। বর্তমানে প্রতিটি মিটারে প্রতি মাসে ৩০ টাকা করে ডিমান্ড চার্জ ও ১০ টাকা করে সার্ভিস চার্জ ধার্য আছে। এটা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৪০ টাকা ও ২০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে কোনো কোনো বিতরণ কোম্পানি।
দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির (গ্যাস) দাম বাড়ানো হয়েছে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে তেলও (ফার্নেস অয়েল) কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদনমূল্য বিক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি পড়ছে। সরকারকে এখনো বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তাই দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি তো নেই-ই, বরং দাম কমানোর সুযোগ আছে। সরকারও বলেছিল ২০১৩-১৪ সালে দাম কমানোর কথা। সেটা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কিন্ত তার দায়ভার গ্রাহকের ঘাড়ে চাপানো তো অনৈতিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি খাতের কয়েকজন বিশেষজ্ঞও বলেন, দাম না বাড়িয়েও বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তা হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি তেল (ফার্নেস) বাজারমূল্যে সরবরাহ করা।
বর্তমান বাজারদরে ফার্নেস তেল থেকে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ৭ টাকার কম। বেসরকারি যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সরকার ফার্নেস তেল আমদানি করার লাইসেন্স দিয়েছে, তারা বর্তমানে এই দামে সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে।
অন্যদিকে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সরকারি মালিকানাধীন পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছ থেকে সরকার-নির্ধারিত দামে ফার্নেস তেল নিচ্ছে, তাদের উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১২ টাকার বেশি। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি লিটার ফার্নেস তেলের দাম ২২ থেকে ২৪ টাকা। আর বিপিসি বিক্রি করে ৪২ টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস তেলের দাম বাজারদর অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বর্তমান বিক্রয়মূল্যের চেয়ে কমে আসবে। তখন দাম বাড়ানোর কোনো প্রশ্ন উঠবে না। কিন্তু সরকার তা না করে বিদ্যুৎ খাতে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করে রেখেছে। এতে সরকারের যে বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে, তা-ও নয়। কেননা, সরকার একদিকে ফার্নেস তেল বেশি দামে সরবরাহ করে মুনাফা করছে, অন্যদিকে বিদ্যুতের উৎপাদনমূল্য বেশি পড়ায় ভর্তুকি দিচ্ছে।
পিডিবির উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র বলছে, ফার্নেস তেলের দামে সমতা না থাকায় অনেক কেন্দ্রের কাছ থেকে তারা বিদ্যুৎ কেনে বিক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি দামে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি চালাতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে। গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি কেনায় পিডিবির ব্যয় হয়েছিল ৩৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। এ বছর তা হবে প্রায় ৪২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা।
ক্যাব-এর জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, আগে দাম বাড়ানোর আদেশে বিইআরসির নির্দেশনা ছিল পিডিবি তথা সরকারকে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের (লিস্ট কস্ট অপশন) বিকল্প পথ অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু তা করা হয়নি বা হচ্ছে না। বেশি দামের অর্থাৎ তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনই বাড়ানো হচ্ছে অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি। আর সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস তেলের দাম বাজারদর অনুযায়ী করে দিলে উৎপাদন ব্যয় অনেকখানি কমে আসত। তা-ও করা হয়নি বা হচ্ছে না।
এম শামসুল আলমের মতে, পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে অনেক রকম কর ও শুল্ক রেয়াতের বিধান রয়েছে। কিন্তু পিডিবিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না দিয়ে অন্য কোম্পানিকে দিয়ে করানো হচ্ছে। এতে বিভিন্ন শুল্ক ও কর হিসেবে ১৮ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের ঘাড়ে চাপানো হয়। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোর বিতরণ খরচ, জনবলের পেছনে খরচ যৌক্তিকভাবে বাড়ছে না। ব্যয় সাশ্রয়ের কোনো উদ্যোগ কোথাও দেখা যায় না। পদ্ধতিগত লোকসান (সিস্টেম লস) কমিয়ে মুনাফা বাড়ানোর কার্যক্রমও যথেষ্ট সফল হচ্ছে না।