টি-টোয়েন্টিতে ফেরার ইচ্ছা নেই। তবে ওয়ানডে ক্যারিয়ার যতটা সম্ভব লম্বা করতে চান মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেখান থেকে বিদায়ও নিতে চান মাথা উঁচু করে, মর্যাদার সঙ্গে। কাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওয়ানডে নিয়ে চিন্তাভাবনা, নিজের বোলিং এবং বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলেছেন ওয়ানডে অধিনায়ক
প্রশ্ন: ওয়ানডে ক্রিকেটে সামনের সময়টা বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার ব্যাপার আছে। তা ওয়ানডে নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মাশরাফি: টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। এটাই স্বাভাবিক, এভাবেই হয়। সে তুলনায় ওয়ানডেতে আমরা এক লাফে অনেক দূর এগিয়েছি। দল সাফল্য পাচ্ছে, আমি নিজেও খেলাটা উপভোগ করছি। ইচ্ছা আছে, ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা আরেকটু লম্বা করার। তবে সেটার সময় নির্ধারণ করে দেওয়া কঠিন। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কখন কী কঠিন হয়ে যায়, কোনটা সহজ হয়ে যায়, বলা মুশকিল। আমার চিন্তা হচ্ছে, ওয়ানডেটা এখনো উপভোগ করছি, তাই আরও কিছুদিন খেলে যাওয়া। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতি যদি আসে যে, আমার একটু খারাপ সময় যাচ্ছে আর আমার ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে, তখন তো আমাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
প্রশ্ন: শ্রীলঙ্কা সিরিজের তিনটি ওয়ানডেতেই আপনি ভালো বোলিং করেছেন। ২০১৫-তেও ভালো করেছেন। কিন্তু মোস্তাফিজ-তাসকিনরা আসায় আপনার ভূমিকা তখন ছিল ভিন্ন। সেটা কি এ বছর একটু বদলেছে?
মাশরাফি: ২০১৫ সালে আমি নতুন বলে বলতে গেলে বোলিংই করিনি। হয়তো এক-দুটি ম্যাচে করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক ম্যাচে মনে হয় করেছিলাম। আমার জন্য কাজটা কঠিন ছিল। কারণ ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আমি নতুন বলে বোলিং করে আসছি। পেস বোলিংয়ে আমার যত স্কিল আছে, সেটা নতুন বল ঘিরেই বেশি। একজন বোলারের ভিত একটা জায়গা থেকেই তৈরি হয়। যেমন মোস্তাফিজ নতুন বলের চেয়ে সেমি নতুন বলে বেশি কার্যকর তার কাটারের জন্য। তাসকিন-রুবেল ফিল্ডিংয়ের বিধিনিষেধ যখন একটু কমে আসে, তখন বেশি কার্যকর। নতুন বলে সৈয়দ রাসেল, তাপস বৈশ্য, মঞ্জু ভাইয়ের বোলিং বেশি কার্যকর ছিল। আমারও তা-ই। শুরু থেকে নতুন বলেই বোলিং করেছি। কিন্তু ২০১৫ সালে নতুন অনেক বোলার আসার পর কোচের সঙ্গে আলোচনা করে ইতিবাচকভাবেই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ পুরোনো বলের বোলিংয়েও আমি দ্রুত মানিয়ে নিই। তবে শুরুতে কাজটা কঠিন মনে হয়েছিল। পরে উপভোগ করেছি। দল সফল হওয়ায় ভালো লেগেছে।
প্রশ্ন: শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে আপনার প্রথম স্পেলটাই বলতে গেলে খেলার গতিপথ ঠিক করে দিয়েছিল। এই সিরিজের পর শুরুতে বোলিং করার আত্মবিশ্বাসটা কি বেড়ে গেছে?
মাশরাফি: নতুন বলে ভালো বোলিং করাটা নির্ভর করে আত্মবিশ্বাসের ওপর, একই সঙ্গে সামর্থ্যের ওপর। মোস্তাফিজ চোটে পড়ায় আমি অনেক দিন পর নতুন বল হাতে নিয়েছি আফগানিস্তানের বিপক্ষে। যেহেতু এটাই আমি সারা জীবন করেছি, মাঝে এক বছর না করলেও আমার আত্মবিশ্বাস ছিল। আফগানিস্তানের সঙ্গে শুরুতেই শেহজাদ আমাকে একটা ছয় মারে। কিন্তু যখনই একটা ব্রেক থ্রু পাই, আমার আত্মবিশ্বাস চলে আসে। তখন থেকেই মনে হয়, আমি ভালো অবস্থায় আছি। ইংল্যান্ডের সঙ্গেও আমি নতুন বলে ব্রেক থ্রু দিয়েছি। নিউজিল্যান্ডে আমি প্রথম ওভারে গাপটিলের উইকেট পাই। প্রথম ওয়ানডেতে ৮ ওভারে ৩৩ রান দিই। আত্মবিশ্বাস ছিল, আর সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে ওই সময় এ দায়িত্বটুকু আমাকে নিতেই হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি এক বছর নতুন বলে বল করিনি বলে এটাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে পারি না।
প্রশ্ন: এখন তো বিশ্ব ক্রিকেটে ওপেনাররা প্রথম থেকেই খুব আক্রমণাত্মক খেলে। এই যে শুরুতেই শেহজাদ ছক্কা মেরে দিয়েছিল আপনাকে, এমন পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা কতটা কঠিন?
মাশরাফি: আমি যে সময় ক্রিকেট খেলা শুরু করি, সেই সময়টা আমাকে আত্মবিশ্বাস দেয়। এখন কিন্তু তখনকার মতো অত খতরনাক ব্যাটসম্যান নেই। আমি যখন শুরু করি, তখন ভারতের হয়ে ওপেন করত গৌতম গম্ভীর-শেবাগ। অস্ট্রেলিয়ার ছিল হেইডেন-গিলক্রিস্ট। শ্রীলঙ্কার জয়াসুরিয়া-উপুল থারাঙ্গা। কালুভিতারানাও ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার স্মিথ-গিবস। এখনকার ওপেনারদের যদি দেখেন, তারা কিন্তু ওই ধরনের ওপেনার না। ওটা আমার মাথায় কাজ করে। তখনকার তুলনায় এখনকার ওপেনাররা টেকনিকের দিক দিয়ে অত নিখুঁত নয়।
প্রশ্ন: কোর্টনি ওয়ালশ আসার পর তাঁর সঙ্গে আপনার অনেক কথা হয়েছে। আপনি বলেন, ড্রেসিংরুমে তাঁর উপস্থিতিটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার জন্য এই বয়সে বোলিংয়ে ছোটখাটো পরিবর্তন আনা কতটা সহজ?
মাশরাফি: আমি আসলে টেকনিক্যাল পরিবর্তন কখনোই করিনি। আমার খারাপ সময় তো কতই গেছে। তখনো আমি বিচলিত হইনি। কারণ এভাবে বল করেই আমি ভালো খেলেছি। কোনোভাবে হয়তো আত্মবিশ্বাস নিচে নেমে গিয়েছিল। ওয়ালশ আসার পরই আমি আবার নতুন বল নিই। তাঁর সঙ্গে আমি একটা কাজই করি, আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর কাজ। আর কিছু না। এখন কিছু পরিবর্তন করে সফল হওয়া খুব কঠিন।
প্রশ্ন: ওয়ালশ ঠিক কী ধরনের কথা বলেন, যেটা শুনে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়?
মাশরাফি: নির্দিষ্ট কিছু নয়। এলোমেলো কথা থেকেও তা হতে পারে। ওয়ালশ কিংবদন্তি। তিনি হয়তো আপনাকে এমন একটা কথা বলবেন…দশটা কথার মধ্যে ওই একটা কথাই আপনার জন্য খেটে যেতে পারে। ওই একটা কথাই আপনাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। আমার ক্ষেত্রে ওটাই হয়েছে। আমি ওনার সঙ্গে সব সময় বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলি। এ রকম হলে আপনি কী করতেন…আপনি কত ওভারের স্পেল করতেন, বিভিন্ন কিছু। এলোমেলো কথা। এ রকম করতে করতেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচের দিন সকালে ওয়ালশ আমাকে বললেন, ‘তুমি আজ ৫ উইকেট পাবে।’ আমি চারটি পেয়েছি। মাঠ থেকে বের হওয়ার পর কোচ বললেন, ‘একটা জায়গায় তুমি আমার কথা রাখতে পারোনি।’ তাঁর মতো মানুষের উপস্থিতিটাই আসলে বড়। তাঁর ছোট একটা কথাই হয়তো আপনাকে বদলে দেবে।
প্রশ্ন: বোলিংয়ের ক্ষেত্রে আপনার কি বিশেষ কিছু আছে? ধরুন কোনো একটা বলে নির্দিষ্ট কিছু একটা হলো, সঙ্গে সঙ্গে আপনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন…
মাশরাফি: বোলার হিসেবে একটা উইকেটই আপনাকে সবচেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস দেবে। এটাই স্বাভাবিক। প্রথম বলটা যদি আপনি ভালো জায়গায় করতে পারেন, আপনি যেটা চাচ্ছেন সেটাই যদি হয়, তখন অনেক বেশি সুবিধা পাবেন। আমার মনে হয়, আমাদের বোলাররা চাইলেই তাদের ইচ্ছামতো ইনসুইং বা আউটসুইং করাতে পারে না। এটা হয়ে যায়। হয়ে যাওয়া আর করাতে পারার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। করাতে পারা বলে কী হবে, আপনি অবশ্যই তা জানেন। আর হয়ে যাওয়া বলে কী হবে, তা আপনিও জানেন না, ব্যাটসম্যানও জানে না। যারা ইচ্ছামতো কিছু করাতে পারে না, তারা হয়তো ভালো জায়গায় বল ফেলেই আত্মবিশ্বাস পায়। তবে আবারও বলি, একজন বোলারের জন্য প্রথম বলটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বোলাররা একটা উইকেট পাওয়ার পর নতুন ব্যাটসম্যানকে শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক বল করতে পারে না। হয়তো প্রথম বলটাই বাইরে করে দেয়। এ নিয়ে কোনো আলাপ হয় দলে?
মাশরাফি: এটা অভিজ্ঞতার ব্যাপার। আমাদের বোলাররা সব অনভিজ্ঞ। মোস্তাফিজ যতই সফল হোক, ওর সাফল্যের মাত্রা কিন্তু এখন কমবে। আপনি আশা করতে পারেন না, ও সব সময় ৫ উইকেট পাবে। এটা মেনে নিতে হবে। কারণ ওকে পৃথিবীর সবাই এখন আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে। ওরা ভাবে, মোস্তাফিজ বাংলাদেশের একমাত্র উইকেটশিকারি বোলার। ওকে খেলে দিতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মোস্তাফিজ, তাসকিন, রুবেল সবার সামনে এখনো লম্বা সময় পড়ে আছে। এটা সময়ের সঙ্গে, খেলতে খেলতে পরিবর্তন হবে। আমার মনে হয় না, এটা বেশি দিন আমাদের সমস্যা হয়ে থাকবে।
প্রশ্ন: শ্রীলঙ্কা সফরে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে থেকে বাংলাদেশের সেরা প্রাপ্তি বলবেন কি মেহেদীকে?
মাশরাফি: সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ও অসম্ভব ইতিবাচক একজন খেলোয়াড়। আমি এটাতেই সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি। ও ভালো খেলে তা জানতাম। কিন্তু ও যে মানুষ হিসেবেও এত ইতিবাচক, তা জানা ছিল না। তৃতীয় ওয়ানডের কথাই বলি। আমি যখন ২৭-২৮ ওভারের সময় ব্যাটিংয়ে যাই, ওকে বলি আমরা অন্তত ৪০-৪২ ওভার পর্যন্ত ব্যাট করব। এটা বলেছিলাম, কারণ ততক্ষণে ৬-৭ উইকেট পড়ে গেছে। ও বলছে, ঠিক আছে। কিন্তু বাঁহাতি স্পিনারকে এক ওভার মেডেন দেওয়ার পর ও আমাকে বলল, ‘ভাই, আমি এভাবে পারছি না। এমনিতেই তো আমরা হারব। দেড় শ রানে হারা যা, দুই রানে হারাও তা। আমরা বরং ইতিবাচক খেলি। তাহলে সুযোগ তৈরি হবে। তখন হয়তো আমরা জিততেও পারি।’ পরের ওভারে কুলাসেকারাকে আমি দুটি চার মারি, ও দুটি চার মারে। ও তখন বলল, ‘ভাই, এটাই আমাদের খেলা। আমরা এভাবেই খেলব।’ ওই ম্যাচ আমরা হেরেছি। কিন্তু আমার কাছে ওর ইতিবাচক মানসিকতা ভালো লেগেছে।