কুমিল্লায় জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রেখেছে পুলিশ; মৌলভীবাজারে অভিযান

Slider জাতীয় সারাদেশ

0f473d7e101b7a394caaeb6b52ca7833-58dc1f178d1f6

 

ঢাকা;  কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বাগমারা এলাকার বড় কবরস্থান–সংলগ্ন একটি বাড়ির দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন র‍্যাবের এক সদস্য। গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তোলা ছবি l এমদাদুল হকসিলেটের আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শেষ হওয়ার ছয় ঘণ্টার মাথায় মঙ্গলবার গভীর রাতে পাশের জেলা মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ নামের এই অভিযানে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সঙ্গে সোয়াটও যোগ দিয়েছে।
মৌলভীবাজারে অভিযান শুরুর ১৫ ঘণ্টার মাথায় ১৬৮ কিলোমিটার দূরে কুমিল্লায় আরেকটি জঙ্গি আস্তানা ঘেরাও করে পুলিশ। গতকাল বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে কুমিল্লা পুলিশ ওই আস্তানা ঘেরাও করলেও ভেতরে অভিযান চালায়নি।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, আজ বৃহস্পতিবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। তাই এই জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হবে শুক্রবার থেকে। বাড়িটি ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। আশপাশের লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
.
এই তিনটি আস্তানাও নব্য জেএমবির বলে জানিয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। দুই সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুটি জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে চারজন নিহত হয়। এর মধ্য দিয়ে গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর নব্য জেএমবি আবার আলোচনায় আসে। এরপর ১৭ মার্চ ঢাকার আশকোনায় র্যা বের ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলা চালায় এক জঙ্গি। এরপর ২৩ মার্চ দিবাগত রাতে সিলেটের আতিয়া মহল ঘেরাও করে পুলিশ। ২৫ মার্চ সেখানে সেনাবাহিনী ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ অভিযান চালায়। চার দিন পর ওই অভিযান শেষ হয়। তাতে চার জঙ্গি নিহত হয়। তার আগে ২৪ মার্চ ঢাকায় বিমানবন্দর গোলচত্বরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে এক জঙ্গি এবং পরদিন সিলেটে অভিযানস্থলের কাছে দুটি বিস্ফোরণে দুই পুলিশসহ ছয়জন নিহত হন।
১১১ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার রাতে অপারেশন টোয়াইলাইট শেষ হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও আতিয়া মহলের ভেতরে এখনো দুই জঙ্গির লাশ পড়ে রয়েছে। পুলিশের বোমা অপসারণ দল আজ ওই বাড়িটি বিস্ফোরকমুক্ত করার কাজ শুরু করবে।
এরই মধ্যে মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান অপারেশন হিট ব্যাক শুরু হয়। গতকাল ওই দুটি জঙ্গি আস্তানার দুই কিলোমিটার চৌহদ্দিতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। ওই এলাকাগুলোতে দিনভর মাইকিং করা হয়।
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ জালাল প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে পৃথক দুটি স্থানে দুটি বাড়ি ঘিরে রাখা হয়েছে। আস্তানা থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে তাঁরা মৌলভীবাজার শহরের বড়হাট আবুশাহ দাখিল মাদ্রাসা গলিতে দোতলা একটি বাড়ি জঙ্গি আস্তানা হিসেবে শনাক্ত করে ঘিরে ফেলেন। এরপর ভোরে শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নাসিরপুর গ্রামে আরেকটি জঙ্গি আস্তানা শনাক্ত করে সেটিও ঘিরে ফেলা হয়।

মৌলভীবাজার শহরের বড়হাটের জঙ্গি আস্তানাটিতে রাত থেকে দায়িত্ব পালন করা জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ওই আস্তানা থেকে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে প্রথম গুলি করা হয়। সম্ভবত সেটি পিস্তলের গুলি ছিল।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, এরপর সকাল সাতটার দিকে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। নয়টা পর্যন্ত কয়েক দফা গুলির শব্দ পাওয়া যায়।
পুলিশ পুরো এলাকা ঘেরাও করে রেখেছে। আশপাশের লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থলের আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলেন। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা থেকে ঘণ্টাখানেক থেমে থেমে গুলির শব্দ আসে ঘটনাস্থল থেকে। রাত সাতে নয়টায় সর্বশেষ গুলির শব্দ শোনা যায়। এরপর রাত ১২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সুনসান নীরবতা ছিল।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সকাল ১০টার পরে আস্তানার ভেতর থেকে জঙ্গিরা দুটি গ্রেনেড ছোড়ে। এর মধ্যে একটি বিস্ফোরিত হয়, আরেকটি বিস্ফোরিত হয়নি। পুলিশ সদস্যরা দেখেছেন, দুটি গ্রেনেডের মধ্যে একটি ছুড়েছে একজন নারী। সন্ধ্যার পর আস্তানার চারপাশে জেনারেটর বসিয়ে আলোর ব্যবস্থা করে পুলিশ।
মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শহরের বড়হাটে অপর আস্তানার ভেতর থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের জন্য বেলা দুইটার দিকে পুলিশ আহ্বান জানায়। জবাবে জঙ্গিরা গুলি ছোড়ে। ওই আস্তানাটি পুলিশ ও র্যা ব ঘিরে রেখেছে।

পুলিশ জানায়, বড়হাট ও নাসিরপুরের এই দুটি বাড়ির মালিক একজন। তিনি লন্ডনপ্রবাসী, নাম সাইফুর রহমান। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ও মালিকের এক আত্মীয়কে আটক করা হয়েছে।
বাড়ি দুটির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাইফুর রহমানের মামাতো বোনের স্বামী জুয়েল। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নাসিরপুরের গাছ ঘেরা ওই বাগানবাড়িতে মূলত তিনটি পৃথক টিনশেড বাড়ি আছে। একটিতে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। এক ঘরের একটি বাড়িতে একজন রিকশাচালক থাকেন। অন্য বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল সন্দেহভাজন জঙ্গিরা। সেখানে তিনটি ঘর রয়েছে। ভাড়া দেওয়ার আগে বাড়ির মালিক লন্ডন থেকে এলে এখানে থাকতেন।
জুয়েলের ভাষ্য, নাসিরপুরের টিনশেড বাড়িটিতে গত জানুয়ারিতে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা ওঠে। নাম মাহফুজ এবং বাড়ি টাঙ্গাইলে বলেছে। নিজেকে একটি কোম্পানির ডিলার হিসেবে পরিচয় দেয়। সাত হাজার টাকায় বাড়িটি ভাড়া দেওয়া হয়। ঘরে তার সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ি, চার শ্যালিকা, স্ত্রীসহ আট সদস্য থাকত। এর মধ্যে শিশুও রয়েছে।
মৌলভীবাজার শহরের বড়হাটের বাড়ির ভাড়াটে সম্পর্কে জুয়েল বলেন, বেলাল নামে এক ব্যক্তি সেখানে ভাড়া নিয়েছে, নিজেকে একটি কোম্পানির ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে।

শহরের বাড়িতে অভিযানের খবর শুনে লন্ডনপ্রবাসী মালিক সাইফুর রহমান ভোরে তাঁর গ্রামের পরিচিত লোকদের ফোন করে তাঁর বাগানবাড়ির ভাড়াটেদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে অনুরোধ করেন। গ্রামের নান্নু মিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাইফুর রহমান ভোরে তাঁকে ফোন করে নাসিরপুরের বাড়িতে গিয়ে ভাড়াটেকে ডাকতে বলেন।
নান্নু মিয়া বলেন, ফোন পেয়ে তিনি আরও পাঁচ-ছয়জনকে নিয়ে ওই বাড়িতে যান। তাঁদের সঙ্গে পুলিশও ছিল। ভাড়াটের ঘরে কলবেল টিপলে ভেতর থেকে একজন দরজা খোলে। পুলিশ দেখে সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দেয়। একটু পরে ঘরের ভেতরে হাতুড়ি পেটানোর মতো করে একটা শব্দ হয়। এরপরই পুলিশ উপস্থিত সবাইকে সরে যেতে বলে। তারপর ওই বাড়ি থেকে বিকট শব্দ শোনা যায়।
সোয়াটের অভিযান
বেলা পৌনে পাঁচটার দিকে একটা মিনিবাস ও চারটা মাইক্রোবাসে ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত দল সোয়াট ঘটনাস্থলে আসে। একই সময়ে আসে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোমা অপসারণ দল।
পৌনে ছয়টার দিকে সোয়াটের দুটি গাড়ি ঘটনাস্থলের পেছন দিকে যায়। বৃষ্টির মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ১৮ মিনিটে গুলি শুরু হয়। টানা গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে নিস্তব্ধ গ্রামটি। সন্ধ্যা ৭টা ২২ পর্যন্ত কখনো থেমে থেমে কখনো একনাগাড়ে গুলির শব্দ শোনা যায়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, রাতের অন্ধকারে এ ধরনের অভিযান চালানো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তাই রাতে কিছুটা বিরতি নিয়ে আজ দিনের আলোতে আবার অভিযান শুরু হবে। সারা রাত সতর্ক পাহারা থাকবে।
সিলেটের ডিআইজি কামরুল আহসান রাত সাড়ে আটটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান চলমান রয়েছে।
মৌলভীবাজারের জঙ্গি আস্তানার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, দুটি জঙ্গি আস্তানার মধ্যে একটিতে তিন-চারজন, আরেকটিতে আরও কিছু বেশি জঙ্গি থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

কুমিল্লা নগরের দক্ষিণ বাগমারা-সংলগ্ন গন্ধমতি বড় কবরস্থানের পশ্চিম পাশে দেলোয়ার হোসেনের নির্মাণাধীন তিনতলা বাড়ির নিচতলায় জঙ্গি রয়েছে সন্দেহে বাড়িটি ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে ওই বাড়ি ঘিরে রাখা হয়। জেলা পুলিশ, র্যা ব ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে আছেন। বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষে ওই জঙ্গি বোমা ও বিস্ফোরক নিয়ে অবস্থান করছে বলে পুলিশের ধারণা।
বাড়িটির নিচতলার আরেক পাশে বিজিবির এক সদস্যের পরিবার ভাড়া থাকে। দ্বিতীয় তলায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেস করে থাকেন। তৃতীয় তলার নির্মাণকাজ এখনো কাজ শেষ হয়নি।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এক জঙ্গিকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কুমিল্লা শহরের দক্ষিণ বাগমারা এলাকার দেলোয়ার হোসেনের বাড়িটি ঘেরাও করে পুলিশ। তিনি বলেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ করে কাল শুক্রবার এই আস্তানায় অভিযান চালানো হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *