কিছু কিছু স্থান আছে যেগুলো সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা থেকে ধীরে ধীরে মুছে যায়। সেগুলো পরিণত হয় অপছন্দের রাজনৈতিক শাষকগোষ্ঠী বা দূরবর্তী অতিক্ষমতাধর সরকারের সংক্ষিপ্ত নামে। আমেরিকায় এই জায়গাটি হলো ‘ওয়াশিংটন, ডিসি’। ইউরো সমালোচকদের জন্য ‘ব্রাসেলস’। আর বৃটেনের এই সমালোচিত রাজসিক দূর্গ হলো ‘ওয়েস্টমিনস্টার।
তারপরও আজ যখন বাতাসের তরঙ্গ আর সোশাল মিডিয়া টাইমলাইনগুলোয় ভয়ঙ্কর সহিংস সংবাদের ছড়াছড়ি তখন ‘ওয়েস্টমিনস্টার’ যেন তার কোটেশন মার্কটা হারাতে শুরু করলো। দুপুর গড়ানোর পর এ জায়গাটিকে আর রাজনৈতিক শ্রেণীর ঘৃণিত ঘাটি হিসেবে দেখা হচ্ছিল না, বরং আর দশটা জায়গার মতো পরিণত হলো যেনÑ যেখানে অফিস কর্মী, পর্যটক, নিরাপত্তা রক্ষী আর বেড়াতে আসা একদল স্কুলশিশুদের পদচারণা।
অন্য কোন দিন টোবিয়াস এলউডকে ¯্রফে আরেকজন টোরি এমপি হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু খবর এলো যে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়া আহত এক পুলিশ সদস্যকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় সিপিআর এবং মাউথ-টু-মাউথ রিসাসিটেশন দিয়েছেন। আর সেইসঙ্গে তিনি একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিলেন যেন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা এই এমপি ২০০২ সালে বালি বোমা হামলায় নিজের ভাইকে হারিয়েছেন।
ওদিকে, কমন্সের চেম্বারে নিরাপত্তা স্বার্থে আটকে পড়েন এমপিরা। তাদের অনেকেই ফোনে ছিলেন। আমাদের মতোই খবর দেখছিলেন। তবে তাদের দুশ্চিন্তাটা একটু হলেও ছিল বেশি: তারা বন্ধু, সহকর্মী আর নিজেদের অধীনস্তদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। সবার মাথায়ই ছিল একই চিন্তা: হতাহতের মধ্যে পরিচিত কেউ যদি থাকে?
হামলার সময়, আমি ওয়েস্টমিনস্টারে ছিলাম (পার্লামেন্টে নয়)। এক এমপির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ বৈঠক শেষে উঠছিলাম তখনই হামলা শুরু। তিনি নিরাপদ আছে কিনা জানার জন্য স্ত্রীর কাছ থেকে টেক্সট মেসেজ পেয়ে ঘটনাটি জানতে পারেন। টিভি পর্দায় হয়তো তাকে আর দশটা রাজনীতিকের মতো দেখাবে। কিন্তু আজ যদি মানুষ তাকে দেখতো তাহলে একজন সাধারণ মানুষ দেখতে পেতো।
তারপরও, রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিষয় যখন আসেÑ যারা কিনা আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারপদ্ধতিকে সচল রাখেনÑ তখন আমাদের প্রতিনিধিত্ব করতে নির্বাচিত করা ব্যক্তিরা ভোট দেয়ার পরও যে মানুষই থাকেন সেটা মনে করিয়ে দিতে সম্ভবত আমাদের সহিংস ট্রাজেডির প্রয়োজন হয়। গত বছর ছিল জো কক্সের হত্যাকান্ড যা মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, একজন এমপিও আর দশটা সাধারণ মানুষ ছাড়া কিছুই নন। সে সময়, রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে আমরা প্রায়ই আগ্রাসী ভাষা ব্যবহার করে যেভাবে কথা বলি অনেকেই সেক্ষেত্রে অনেকটা সংযত হয়েছিলেন। কিছুদিন আমরা নিজেদের দমিয়ে রাখলাম। কিন্তু ফের সেই পুরোনো অভ্যাসে ফিরে গেলাম।
ওয়েস্টমিনস্টারের নিন্দা যারা করেন, তারা যদি আজ দেখতেন! যে গতিতে পুলিশ আর এমার্জেন্সি সার্ভিসগুলো বিপদের দিকে ছুটে গেলো যেখানে কিনা সহজাত মানবিক প্রবৃত্তি আমাদের বেশিরভাগ মানুষকে বলবে দূরে পালাতে। ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে আহত অবস্থায় মানুষকে পড়ে থাকতে দেখে সাধারণ মানুষ যেভাবে তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলো। প্রহরারত পুলিশ সদস্যদের ট্রেতে করে চা এনে দিলেন কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী। পর্যটকরা দলবেধে ছুটলো নিরাপদ স্থানে। আর পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল লবিতে লকডাউনে আটকে পড়া সবাইকে উজ্জীবীত করতে গান দলবেধে গান গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো স্কুলের বাচ্চাদের দলটি।
গত বছর ঠিক এই দিনে, আত্মঘাতী হামলাকারীদের টার্গেট হয়েছিল ব্রাসেলস। এতে নিহত হয়েছিল ৩২ জন। কয়েকদিনের জন্য ইউবিরোধী বাগাড়ম্বরপূর্ণ ঘৃণিত ‘ব্রাসেলস’ হয়ে গেলো, ট্রাজেডির দৃশ্যপট ব্রাসেলস। ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে আমি একই ধরণের রূপান্তর প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সেবার ওকলাহোমা শহরের একটি মার্কিন সরকারী ভবনে বোমা হামলা হয়েছিল। নিহত হয়েছিল ১৬৮ জন। আহতদের বহন করা আর সন্তানদের শোকে বিলাপ করতে দেখার আগ পর্যন্ত ‘ফেডারেল আমলারা’ ছিল ঘৃণিত এক শ্রেণী। আজ ছিল ‘ওয়েস্টমিনস্টারের’ পালা। ¯্রফে রূপক নয়। মন্দ আর ফন্দিফাজ রাজনীতিকদের দূরবর্তী দূর্গ নয়, বরং সত্যিকার এক স্থান যা সত্যিকারে মানুষ দিয়ে ঠাসা। অন্য যে কারও মতোই প্রাণঘাতী সহিংসার ঝুঁকিতে একইরকম অরক্ষিত।
[জনাথন ফ্রিডল্যান্ড গার্ডিয়ানের কলামিস্ট। ওপরের লেখাটি তার লেখা ‘ব্রেভারি এন্ড সিম্পল হিউম্যানিটি হ্যাভ শোন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাট ইটস বেস্ট’ শীর্ষক কলামের অনুবাদ।]