ঢাকা; প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বাংলাদেশ ও ভারত পাঁচ বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক সই করতে যাচ্ছে। সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) খসড়ায় প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা এবং এই শিল্পের বিকাশে যৌথ উদ্যোগ, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, মহাকাশ প্রযুক্তি, গবেষণা এবং সামুদ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নে একে অন্যকে সহায়তার কথা বলা আছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রগুলো গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের প্রায় তিন মাস আলোচনার পর ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখার সমঝোতা স্মারক’-এর খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে এটি সই হতে পারে।
খসড়া সূচি অনুযায়ী চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শেখ হাসিনার ৭ এপ্রিল নয়াদিল্লি যাওয়ার কথা আছে। ৮ এপ্রিল শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর সইয়ের জন্য যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হয়েছে, তার তালিকায় আছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সমঝোতা স্মারকটি।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে প্রথমবারের মতো ঋণচুক্তির আওতায় সমরাস্ত্র কেনাকাটার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই নিয়েও আলোচনা চলছে। চূড়ান্ত হওয়ার পর সমঝোতা স্মারকটি সই হলে ভারত থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা (৫০ কোটি ডলার) সমমূল্যের সমরাস্ত্র কিনবে বাংলাদেশ।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সইয়ের জন্য দুই পক্ষ ৪৯টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে আলোচনা করেছে। তবে এ তালিকায় দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয় তিস্তা চুক্তি নেই। এতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে ৯টি সমঝোতা স্মারক রয়েছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আরও কয়েকটি চূড়ান্ত হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এখন পর্যন্ত এই সফরে তিস্তা চুক্তি সইয়ের কোনো আভাস নেই। শেষ মুহূর্তে এ নিয়ে কিছু ঘটলে তা হবে বেশ নাটকীয় অগ্রগতি। তবে তিস্তা চুক্তি সই না হলে ভারতের পক্ষ থেকে নদীর অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে এবার সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের জন্য ভারত দীর্ঘমেয়াদি একটি রূপরেখা চুক্তি সইয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। গত ডিসেম্বরে ভারতের তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বিভিন্ন স্তরে আলোচনার পর বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পরিবর্তে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত মাসের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ও ভারত সমঝোতা স্মারকের খসড়াটি চূড়ান্ত করেছে।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় কী থাকছে
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা নিয়ে দুই পক্ষ যে সমঝোতা স্মারক সই করার কথা ভাবছে, তাতে দুই দেশের এখনকার সহায়তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে নতুন কিছু ক্ষেত্রের কথাও বলা হয়েছে। এটি করতে গিয়ে দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী আন্তর্জাতিক আইন, জাতীয় আইন, পরস্পরের নিজেদের দেশের আইন, শর্তাধীন বিষয়, নীতি ও প্রথার প্রতি সম্মান জানাবে।
প্রতিরক্ষা খাতের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে দুই পক্ষ প্রশিক্ষণ, সামরিক বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষক ও পর্যবেক্ষক, সামরিক শিক্ষা পাঠ্যক্রম ও তথ্যবিনিময় করবে। সামরিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক সহযোগিতাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে দুই পক্ষ। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কর্মকাণ্ড নিয়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে উভয় পক্ষ সমুদ্রগামী জাহাজ ও উড়োজাহাজের সফর বিনিময়ের আয়োজন করবে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় উভয় পক্ষ সমন্বিত টহল কিংবা যৌথ মহড়া পরিচালনা করবে।
প্রতিরক্ষা শিল্পের সহযোগিতার ক্ষেত্রে যৌথ বিনিয়োগ, মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহযোগিতা, কারিগরি সমর্থন, অভিজ্ঞতা বিনিময়, প্রশিক্ষণ এবং সামুদ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়গুলো যুক্ত আছে।
‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখার সমঝোতা স্মারক’-এর খসড়া অনুযায়ী বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য, গুণগত মান নিশ্চিত এবং পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানি ও সংস্থার মাধ্যমে এই সহযোগিতা হবে। তবে ওই সমস্ত কোম্পানি বা সংস্থার সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষের চুক্তি থাকলে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে তা লঙ্ঘন বা কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। দুই পক্ষই তাদের কোম্পানিগুলোকে এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সহযোগিতার কার্যক্রম ব্যবস্থাপনায় সমর্থন দেবে। দুই পক্ষই তাদের সরকারি নীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত পণ্য উৎপাদন কীভাবে হবে, তা আলোচনা করে ঠিক করবে।
সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী প্রতিরক্ষা সহযোগিতার কাজটি কেমন হচ্ছে, তা পর্যালোচনার জন্য প্রতিরক্ষাসচিব এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার পর্যায়ে বার্ষিক সংলাপ হবে। এই আলোচনা প্রতিবছর পালা করে হবে বাংলাদেশ ও ভারতে।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় যেসব গোপন তথ্যবিনিময় হবে, সেগুলো যাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার না হয়, তা দুই পক্ষ নিশ্চিত করবে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রক্রিয়ার সময় দুই পক্ষ গোপনীয়তা মেনে চলবে।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখার সমঝোতা স্মারকটি সইয়ের পর থেকে মেয়াদ পূর্তির পরদিন নবায়ন হবে। যদি এটিতে কোনো পরিবর্তন আনতে হয়, মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে যেকোনো পক্ষ নোটিশ দিয়ে তা জানাবে।
সইয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে ভারতের সঙ্গে কেন চুক্তির পরিবর্তে সমঝোতা স্মারক সই হচ্ছে এবং এটি নিয়ে সরকারের মধ্যে কোনো ধরনের অস্বস্তি আছে কি না, তা গত সপ্তাহে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ এই প্রথম কোনো দেশের সঙ্গে একটি রূপরেখা সই করতে যাচ্ছে। তাই নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে শুরুতেই চুক্তি না করে সমঝোতা স্মারকের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অস্বস্তি নয়, ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রূপরেখার সমঝোতা স্মারক সইয়ের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এমনকি এটির খসড়া দুই পক্ষ আলোচনা করে চূড়ান্ত করার পরও এ নিয়ে বাংলাদেশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মধ্যে গত সপ্তাহে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
গতকাল সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সফরে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখাসংক্রান্ত এমওইউর পাশাপাশি সমরাস্ত্র কেনাকাটার এমওইউ সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত হলে দুই দেশের প্রতিরক্ষা খাতে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা নিয়ে কয়েকটি সমঝোতা স্মারকও সইয়ের সম্ভাবনা আছে।