‘আমরা ছাদের ওপর থেকে অপারেশন শুরু করি। নিচে কতজন জঙ্গি আছে জানিও না। জঙ্গিরা গুলি করছে, বোমাও ছুড়ছে। আমরাও গুলি করে নিচে নামার চেষ্টা করছি। হঠাৎই পেটে একটা তরমুজ সাইজের বোমা বেঁধে ছাদে চলে এল এক জঙ্গি। ওটা ফাটলেই আমাদের ১০ জনের বাঁচার কোনো উপায় নেই। হঠাৎই আত্মঘাতী হামলাকারী আর সোয়াট দলের মাঝে বোম্ব শিল্ড (বোমা রোধী বিশেষ ঢাল) নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন সোয়াটের সদস্য কনস্টেবল শাওরিদ হাসান। মুহূর্তের মধ্যেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলা আত্মঘাতী হামলাকারীর শরীর। আমাদের সবার শরীরেই আত্মঘাতীর শরীরের মাংস, নাড়িভুঁড়ি ছিটকে এসে লাগল। আর বিস্ফোরণের প্রচণ্ড ধাক্কায় ঢালসহ শাওরিদ ছিটকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। ঢালটাও দুমড়ে-মুচড়ে যায়। শাওরিদ আর তাঁর ঢাল বাঁচিয়ে দেয় সবাইকে।’
গত বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রেমতলায় ছায়ানীড় নামের দোতলা বাড়িটিতে অভিযানের বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সোয়াট (স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিস) দলের একজন কর্মকর্তা। গত তিন দিনে ওই অভিযানে অংশ নেওয়া চারজন সদস্যের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ হয়। সবাই বলছেন, অনেকটা অলৌকিকভাবেই এবার তাঁরা বেঁচে ফিরেছেন। সোয়াটের মতো বিশেষায়িত ইউনিটে কাজ করেন বলে নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁরা জানান, কনস্টেবল শাওরিদ হাসান চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বিস্ফোরণের পরে ঢাল ছিটকে পড়ে তাঁর বাঁ পা ভেঙে গেছে, চোয়ালেও আঘাত লেগেছে। এ ছাড়া শাওরিদের সঙ্গে আহত হওয়া আসিফ আহাম্মদ স্বাদ নামের আরেক সোয়াট সদস্যও হাসপাতালে রয়েছেন। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে তাঁদের দলের দুই সদস্য কানে আঘাত পেয়েছেন। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসা চলছে। এরা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ ও এএসআই আনিসুর রহমান।
অভিযানে অংশ নেওয়া সোয়াটের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এর আগে বিভিন্ন সফল অভিযানের পরে দলে যে আনন্দ থাকে, এবার তা একেবারেই ছিল না। মৃত্যুটাকে মনে হয় এবার কাছে থেকে দেখে এলাম। শাওরিদ যে সাহসের সঙ্গে আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। ওই অভিযানের পরে সোয়াটের অনেক সদস্যের মনেই প্রশ্ন উঠেছে জীবনের এত ঝুঁকি নিয়ে আমরা আসলে কী পাচ্ছি। পুলিশের নিয়মিত বেতন-ভাতার বাইরে আমাদের ঝুঁকি ভাতাটুকুও দেওয়া হয় না। এমনকি যাঁরা কানে আঘাত পেয়ে প্রায় শুনতে পাচ্ছেন না।’
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মীনা তাঁর অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘…একপর্যায়ে বিকট শব্দে বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, আহত হন সোয়াট সদস্য শাওরিদ হাসান ও আসিফ আহাম্মদ। বিস্ফোরণের মাত্রা এতটাই প্রকট ছিল যে ভবনের সিঁড়ির রুম, ছাদের অংশবিশেষ উড়ে যায়। অভিযানের অগ্রভাগে থাকা সোয়াত সদস্য শাওরিদ হাসানের হাতের বিস্ফোরণ প্রতিরোধী ফোর গ্রেডের শিল্ডটি বাঁকা হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শাওরিদের তিনটি দাঁত, ভেঙে গেছে বাঁ পা। তাঁর অদম্য সাহসিকতা ও দুর্বার প্রতিরোধে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় অভিযানে অংশ নেওয়া সোয়াত ও চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সদস্যরা। এ সোয়াট সদস্যের সাহসিকতা আর রণকৌশল ছিল গর্ব করার মতো।’
অভিযানের বর্ণনা দিয়ে এক সোয়াট কর্মকর্তা বলেন, প্রায় সারা রাত ছায়ানীড় বাড়িটি ঘিরে রাখার পরে ভোরে অভিযান শুরু হয়। ছায়ানীড় থেকে দুই বাড়ি পরের একটি বাড়ি থেকে লোকজন বের করে দিয়ে এর ছাদে ওঠেন সোয়াট সদস্যরা প্রথমে ছায়ানীড়ের ছাদে আসেন। এরপর ছায়ানীড়ের পাশের বাড়ি থেকে লোকজন নিরাপদে বের করে দিয়ে সেখানেও অবস্থান নেন সোয়াট সদস্যরা। ছায়ানীড়ের ছাদে উঠে তাঁরা দেখতে পান, এক বোতল পানি, এক প্যাকেট বিস্কুট আর একটা চাপাতি ছাদের এক পাশে রাখা। তাঁরা ধারণা করেন, সারা রাত এখানে বসে জঙ্গিদের কেউ পাহারা দিয়েছেন। ছাদ বেয়ে নিচে নামতে চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু ছাদ থেকে নেমে যাওয়া সিঁড়িটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে একটা গ্রেনেড পড়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর সেটি গুলি মেরে বিস্ফোরণ করা হয়। এ সময় নিচ থেকে জঙ্গিরা গুলি করছিল। সোয়াট সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। এর মধ্যেই কোনো এক ফাঁকে এক তরুণ জঙ্গি বুকে বিস্ফোরক বেঁধে ছাদে উঠে আসে। আল্লাহু আকবার বলে নিজের শরীরে বাধা বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে দেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে যায় এ ঘটনা। এ সময়ই কনস্টেবল শাওরিদ ঢাল হয়ে সবাইকে বাঁচান।
অভিযানের সময় প্রথম আলোর প্রতিবেদক ছায়ানীড়ের ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে ছায়ানীড়ের ছাদ দেখা যায়। অভিযান শুরুর পর সকাল সোয়া ছয়টায় প্রথমে গুলির শব্দ শোনা যায়। এর সাত মিনিট পর আবারও পরপর চারটি গুলির শব্দ আসে। ৬টা ২৮ মিনিটে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়। মুহূর্তেই ওই বাড়ির সিঁড়িঘরের ছাদের টিন উড়ে যায়। এ সময় ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু আগুনের শিখা দেখা যায়। বাড়িটি ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরপর ৬টা ২৮ থেকে ৩৬ মিনিট পর্যন্ত গুলির শব্দ শোনা যায়। এর দুই মিনিট পর অভিযানে অংশ নেওয়া সোয়াট দলের দুই সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান পুলিশের অন্য সদস্যরা। ৭টা ১০ মিনিটে দুটি গুলির শব্দ হয়। এরপর আর কোনো গুলির শব্দ শোনা যায়নি। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ভবনের পেছনে জানালার গ্রিল কেটে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ওই বাসায় আটকে থাকা এক শিশুকে বের করে আনেন। এরপর একে একে অন্যরাও পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।