গড়ে ১ দশমিক ৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার প্রতিদিন

Slider নারী ও শিশু ফুলজান বিবির বাংলা সামাজিক যোগাযোগ সঙ্গী

images

 

 

 

 

নারী নির্যাতনের ধরন যেমন পাল্টাচ্ছে, তেমনি এর সহিংসতাও দিনদিন বাড়ছে। বিশেষত মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা আরো বেশি। ব্র্যাকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে নথিভুক্ত মোট নারী নির্যাতনের মধ্যে মেয়ে শিশু নির্যাতনের হার ২০ শতাংশ। মেয়ে শিশুদের মধ্যে ১২-১৭ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি (৬০ দশমিক ৬৩ শতাংশ) নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১৮ বছরের নিচে প্রতিদিন গড়ে ১ দশমিক ৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার। আর মেয়ে শিশু ছাড়া অন্য নারীদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের হার ৮০ শতাংশ। আজ মঙ্গলবার (১৪ মার্চ, ২০১৭) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের করণীয়’Ñ শীর্ষক জাতীয় পর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে ব্র্যাক পরিচালিত নারী নির্যাতনের ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ ও মূল উপস্থাপনায় এ চিত্র তুলে ধরেন ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়নের কর্মসূচির (সিইপি) কর্মসূচি প্রধান ফারহানা হাফিজ। ব্র্যাক আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন- মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদা শারমীন বেনু। ব্র্যাকের এডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জের পরিচালক কেএএম মোর্শেদ-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেনÑ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম, আইসিডিডিআরবি’র সিনিয়র গবেষক ড. রুচিরা তাবাসসুম নভেদ, ডেপুটি কমিশনার (উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন) ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের প্রধান ফরিদা ইয়াসমীন, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বাবু প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেনÑ ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি এবং সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালক আন্না মিনজ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাহমুদা শারমীন বেনু ব্র্যাকের এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘নারী নির্যাতন’ শুধু একা নারীদের সমস্যা নয়, এটা পুরুষদেরও সমস্যা। এখানে নারী-পুরুষ সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এ দিকটি মাথায় রেখে আমরা এখন প্রতিটি ইউনিয়নে কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। এর পাশাপাশি সরকার নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে ৪৯০ টি উপজেলায় স্থানীয় চাহিদার নিরিখে ১৮ ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে নারীদের সহযোগিতা দিচ্ছে। আয়েশা খানম নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নারীদের আরো বেশি সোচ্চার হওয়ার তাগিদ দেন। তিনি বলেন, নারী নির্যাতন রোধে আমাদের ভালো আইন আছে ঠিকই। কিন্তু অনেক নারী আছেন  যারা এ ধরনের আইন সম্পর্কে জানেন না। এখন আমাদের আইন সম্পর্কে  জানানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মকা-ের কারণে ‘ভালো আইন প্রণয়নে’ সাফল্য এসেছে। এখন সময় এসেছে এগুলের ফলাফল বিশ্লেষণ ও সঠিক মনিটরিং এর মাধ্যমে পরিবার, সমাজ, সুশীল সমাজ, বেসরকারি সংস্থা ও সরকারের সহযোগিতায় একটি একক প্ল্যাটফর্ম গঠন করা। এতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সহজ হবে।  ফরিদা ইয়াসমীন বলেন, শুধু আইন দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ অসম্ভব। এখনও আমাদের সমাজে প্রতিদিন নিগৃহীত হচ্ছেন নারীরা। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের আইন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পাশাপাশি প্রতিটি ব্যক্তি,পরিবার, বেসরকারি সংস্থা, সুশীল সমাজসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আন্না মিনজ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে দাতা সংস্থার প্রতি আরো অর্থায়নের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ক্ষেত্রে দাতাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা এলেও এই খাতে সন্তোষজনক সহায়তা পাওয়া যায় না।  গোলটেবিল বৈঠকে ২০১৬ সালের নারী নির্যাতন চিত্র এবং করণীয় বিষয়সমূহ তুলে ধরা হয়। ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির ২০১৬ সালে ৫৫ টি জেলায় ও ৩৭৯ টি উপজেলায় নির্যাতনের শিকার নারীদের তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ করে। নথিভুক্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, মোট নির্যাতনের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের হার ৬৭ শতাংশ, যৌন নির্যাতনের হার ১৯ শতাংশ এবং মানসিক নির্যাতনের হার ১৪ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে শারীরিক নির্যাতন এবং শিশুদের মধ্যে যৌন নির্যাতন। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ১ দশমিক ৭ জন শিশু ধর্ষণের শিকার।
এতে আরো বলা হয়, নির্যাতনের শিকার নারীদের ৩৯ শতাংশ মামলা বা আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রক্রিয়াধীন ছিল, মাত্র ২৬ শতাংশ কেইস ফাইল হয়েছিল এবং ৭ শতাংশ মামলা সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা হয় এবং ২৮ শতাংশ কেইস কোনো আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
অনুষ্ঠানে আরো বলা হয়, বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হলেও প্রথাগত সামাজিক মূল্যবোধ ও পরিবারের ‘সম্মান’, পুনরায় নির্যাতনের ভয়, উপযোগী পরিবেশ না পাওয়া ইত্যাদি কারণে নারীরা তা প্রকাশ করতে চান না। শুধু গুরুতর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন ছাড়া অন্যান্য নির্যাতনগুলো প্রকাশিত হয় না। ফলে নির্যাতনের যে চিত্র পাওয়া যায় তা বাস্তব ঘটনার চেয়ে অনেক কম।
ব্র্যাকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গড়ে প্রতি মাসে ৬২৪টি, প্রতিদিন ২০ দশমিক ৫টি এবং প্রতিজেলায় মাসে ১১ দশমিক ৩৫টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। প্রায়ই এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও পারিবারিক, সামাজিক ও মামলার দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে অধিকাংশ নারী আইনি পদক্ষেপে যেতে চান না।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের আলোচনা থেকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যেসব চ্যালেঞ্জ উঠে আসে সেগুলো হলো: পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নির্যাতন প্রতিরোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা, সরকারি- বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতা, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *