গ্রাম বাংলা ডেস্ক: চা বাগান। সবুজের মোহন দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। একই মাপের চা-গাছ ঢেউ খেলে পাহাড়-টিলার বুকে। ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না সবুজের এ ঢেউকে। বাড়লেই ছেঁটে ফেলা হয়। গাছগুলোর মতোই যেন চা শ্রমিকদের জীবনও ছেঁটে ফেলা। যেখানে প্রশ্রয় নেই হাসি-আনন্দের। বেঁচে থাকা শুধু বেঁচে থাকার জন্যই। সমাজের মূল স্রোতে তারা মিশতে পারেননি কখনওই। প্রায় ১৭৫ বছর ধরে পুরুষানুক্রমে গ্লানিমাখা জীবনের ঘানি টানছেন তারা। কোন মূল্যই যেন নেই তাদের জীবনের। প্রতি ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটনির দাম মাত্র সাড়ে আট টাকা। তাও অনেক আন্দোলন, অনেক তপস্যার পর শ্রমের এ মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। এর মাঝেও কিন্তু আছে। আট ঘণ্টায় যদি নিরিখ (প্রতিদিন যে পরিমাণ পাতা তুলতেই হবে) পূর্ণ হয় তবেই পড়ে ঘণ্টার এ দাম। নিরিখ পূর্ণ না হলে ঘণ্টার মূল্য কমে আরও।
চা শ্রমিকরা দীর্ঘ দিন ধরেই মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। হাড়ভাঙা খাটুনির বিপরীতে নামমাত্র মজুরি জুটে চা শ্রমিকদের ভাগ্যে। কোন রকমে বেঁচে থাকার হিসাব কষে তাদের উপলব্ধি দৈনিক ৩শ’ টাকার কম মজুরি হলে বেঁচে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। অথচ বর্তমানে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৬৯ টাকা। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে দফায় দফায় বেড়ে মজুরি এ পর্যন্ত এসেছে। এর আগে ২০১৩ সালের মে পর্যন্ত দৈনিক মজুরি ছিল ৬২ টাকা। তার আগে ৫৫ টাকা। এরও আগে ছিল ৪৮ টাকা। অর্থাৎ যতই আন্দোলন হোক এক দফায় ৭ টাকার বেশি মজুরি বাড়ছে না। ২০০৯ থেকে ৫ বছরে চার দফায় মজুরি বেড়েছে ২১ টাকা। সে হিসেবে ৩০০ টাকা মজুরি পেতে হলে চ শ্রমিকদের অপেক্ষা করতে হবে আর ৫৭ বছর।
শ্রমিকদের কম মজুরির বিষয়টি সামনে এলেই বাগান মালিকরা বরাবর ‘রেশন সিস্টেম’কে ঢাল হিসেবে নিয়ে আসেন। তবে তারা এ ‘রেশন সিস্টেমে’র বিস্তারিত কখনওই কারও সামনে তুলে ধরেন না- শুভঙ্করের ফাঁকি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে। চা শ্রমিকদের তথ্যমতে, রেশন ব্যবস্থায় একজন শ্রমিক সপ্তাহে ৩ কেজি চাল বা আটা বরাদ্দ পান। সেগুলো খাওয়ার উপযোগী নয়। তবে বেঁচে থাকার তাগিদে তা-ও গিলতে হয় তাদের। এ বরাদ্দ দিয়েই দৈনিক ৬৯ টাকায় বাঁধা জীবনের হিসাব মেলাতে হয় তাদের। হিসাবের তিনটি রুটি নিয়ে কাজে বের হন তারা। এর একটি সকালে নাশতা হিসাবে খান, সঙ্গে থাকে কাঁচা চায়ের পাতার সঙ্গে মরিচ মেখে তৈরি করা ভর্তা। বাকি রুটিগুলো জমা থাকে দুপুরের খাবারের জন্য। ৬৯ টাকার হিসাবে ফাঁক আছে আরও। এ ৬৯ টাকা থেকেই বাঁচিয়ে রাখতে হয় ছুটির দিনের খরচ। বাংলাদেশে একমাত্র চা শ্রমিকরাই ছুটির দিনে কোন মজুরি পান না। ছুটির দিনের মজুরি যাতে না দিতে হয় তাই ‘হপ্তা’ (সাপ্তাহিক বেতন) সিস্টেম ভাঙতে চান না বাগানের কর্ণধাররা। তাই কোনভাবেই জীবনের হিসাব মেলাতে পারেন না চা শ্রমিকরা। অন্যান্য এলাকার চেয়ে চা বাগানগুলোতে শীতের আধিক্য বেশি থাকলেও সাধ্য না থাকায় শীতের পোশাক কেনারও সামর্থ্য থাকে না তাদের। পুরনো ছেঁড়া-ফাটা পোশাক কিনে বা সংগ্রহ করে শীতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় তাদের। চা শ্রমিকদের থাকার ঘরগুলোর বেশির ভাগেরই মাটির দেয়াল। দেয়াল গলে সহজেই ঢুকে পড়ে শীত। আর বর্ষায় থাকে দেয়াল ধসে মৃত্যুর ঝুঁকি। ঘরের মতো বাইরেও একই অবস্থা। চা শ্রমিকদের এমন সংগ্রামী জীবনের গল্প প্রায় ১৭৫ বছরের পুরনো। সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। উপমহাদেশ জুড়ে তখন বৃটিশ রাজত্ব। বাংলায় রেল লাইন বসবে। নিজেদের স্বার্থেই গ্রামের পথ চিরে রেলের লাইন টানছে বৃটিশ শাসক। লাইন বসানোর জন্য বাংলার বাইরে থেকে মূলত বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে শ্রমিক আনা হয়।
রেল লাইনের কাজ শেষ হলেও সেই শ্রমিকদের একটি বিশাল অংশ বাংলাতেই থেকে যায়। এমনই সময় চা বাগানের ভাবনা আসে বৃটিশদের মাথায়। নেপালিসহ আরও কিছু অবাঙালি শ্রমিক পাঠানো হয়। থেকে যাওয়া অবাঙালি শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের পাঠানো হয় সিলেট-আসাম অঞ্চলে। উদ্দেশ্য, জঙ্গল সাফ করে পাহাড়ি টিলায় চায়ের বাগান তৈরী। শুধু বাগান নয় জনবসতি বিস্তারের লক্ষ্যেও বৃটিশদের এ চিন্তা। পাহাড়-টিলায় জায়গা করে নেয়া সেসব অবাঙালির পরিচয় হয় চা-শ্রমিক হিসেবে। আর তাদের খাটনির শুরুও সেই থেকেই। ১৭৫ বছর আগে যে জীবনের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়েছিল সে জীবনের ঘানি আজও টানছেন তারা। এ সময়ে বাইরের জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এলেও তার কোন ছোঁয়া লাগেনি চা শ্রমিকদের জীবনে। কাল পড়ুন- কালাগুল : নিপীড়নের খ-চিত্র
এখনও তাদের পথ চলতে হয় সামনের জঙ্গল কেটে কেটে। রোদে জ্বলে, বৃষ্টিতে ভিজে কেবলই কাজ করতে হয় তাদের। কাজের ফাঁকে বিশ্রামের জন্য একটু ছায়ারও ব্যবস্থা থাকে না তাদের জন্য। বৃটিশ তাড়িয়ে, পাকিস্তানের পতাকা সরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলেও স্বাধীনতার পরশ পড়েনি চা শ্রমিকদের খেটে খাওয়া দেহে।
চা শ্রমিকদের জীবন এখনও চলছে বৃটিশদের বেঁধে দেয়া নিয়মেই। তারা এখনও শ্রমদাস হয়ে আছেন। চেয়ে চেয়ে দেখেছেন শুধু মালিকানার পরিবর্তন, ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি এতটুকুও। বৃটিশ বিদায়ের পর চা বাগানের দখল নেন পাকিস্তানি পুঁজিপতিরা। এরপর দেশ স্বাধীন হলে ইস্পাহানি, বাওয়ানি, কাশ্মীরি পরিবারের হাতে থাকা বাগানের মালিকানা আসে বাংলাদেশী মালিকদের কাছে। তবে চা শ্রমিকদের ভাগ্য রয়ে গেছে একই। সাদা চামড়ার বৃটিশ মালিকদের চেয়ে কম নন বাদামি রঙের বাংলাদেশী মালিকরাও। বৃটিশদের বাবুয়ানা ষোলো আনাই ধরে রেখেছেন বাবু নামে পরিচিত এ কালের ম্যানেজাররাও। বড় বাবু, ছোট বাবুুদের সামনে বসার অধিকার চা শ্রমিকদের নেই। ডাক পড়লে তবেই কেবল ঘরে ঢোকা যায়। তা-ও ঢুকতে হয় খালি পায়ে।
বাবুরা বিলাসিতার চরমে ভাসলেও চা শ্রমিকদের জীবনে তার সামান্য ছিটেফোঁটাও পড়ে না। এমনকি নিজেদের পরিশ্রমের ফসল চায়ের পূর্ণ স্বাদও তারা পান না কখনও। চা শ্রমিকরা পরম মমতায় সন্তানের মতো আগলে রেখে কুঁড়ি থেকে বড় করে তোলেন চায়ের পাতা। প্রক্রিয়াজাত হয়ে বাহারি মোড়কে ঢাকা সে চা পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে। শুধু পৌঁছে না শ্রমিকদের ঘরে। তাদের কাছে চা বলতে চায়ের কাঁচা পাতাই। বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা চায়ের কাঁচা পাতা লবণ-পানিতে গুলে তাই পান করেন তারা। চা শ্রমিকরা যাতে বাইরের ভুবনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হতে না পারেন সে পথ বৃটিশরাই তৈরি করে রেখেছিল। শ্রমিকদের বাগানের মাঝে বন্দি করে রাখার কৌশল হিসেবে প্রতিটি বাগানের ভেতর মদের দোকান গড়ে তোলা হয়। হাড়ভাঙা খাটুনির পর জীবনের যেটুকু উদ্যম বেঁচে থাকে তা-ও নিংড়ে নেয় স্থানীয়ভাবে পাট্টা নামে পরিচিত এসব মদের দোকান। চা বাগানের বর্তমান মালিকরাও নিজেদের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখছেন এসব পাট্টা।
চা শ্রমিকদের জীবনে আলোর পরশ যাতে না লাগে বৃটিশদের দেখিয়ে দেয়া পথ অনুসরণ করে তার সব রকম যোগানই করে রাখছেন বাগান মালিকরা। তাদের অনাগ্রহের কারণেই পর্যাপ্ত স্কুলের অভাব রয়েছে বাগান এলাকায়। যদিও এখন অনেক এনজিও বাগানের ভেতরে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে তবে তা-ও চলে অনেক তদারকের ভেতর দিয়ে। বাগান মালিকরা কখনই চান না আলো পড়ুক শ্রমিকদের নগ্ন ‘কালো’ গায়ে।