এই দিবসটি উদ্যাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। আজ থেকে ১৬০ বছর আগে ১৮৫৭ সালে মজুরিবৈষম্য ও কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমে এসেছিলেন একটি সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। নারীদের সেই মিছিলে পুলিশ হামলা চালিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং বেশ কয়েকজন নারী শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে।
এরপর ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরে নারী পোশাকশ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। প্রায় ২০ হাজার নারী এতে অংশ নেন। এর মাধ্যমে নারীরা প্রমাণ করেন যে তাঁরাও সংগঠিত হতে জানেন। একই বছর নিউইয়র্কে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে এক নারী সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন ওই পার্টির নেত্রী ক্লারা জেটকিন। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে বিশেষ করে নারীর ভোটের অধিকার দাবি করা হয়। এই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন প্রতিবছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। তখন সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ সাল থেকে ৮ মার্চ দিনটি নারীর সম-অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই বছর দিনটি পালন করা হয়।
১৯১৪ সাল থেকে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে নারী অধিকারের যৌক্তিক দাবিগুলো বিবেচনায় রেখে জাতিসংঘ ‘লিঙ্গসমতা’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৭ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে যায়। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের জন্য উত্থাপিত বিল অনুমোদন পায়। ১৯৮৪ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘ এবং বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে দিবসটি পালনের জন্য আহ্বান জানায়। প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য নারীদের সুদীর্ঘ সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ এই সিদ্ধান্ত নেয়।
২০০৯ সালে বিশ্বের ২৯টি দেশে সরকারি ছুটিসহ প্রায় ৬০টি দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়েছে। নারী দিবস উপলক্ষে যেসব দেশে সরকারি ছুটি দেওয়া হয়, সেই দেশগুলো হচ্ছে আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, গিনি বিসাউ, ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, লাওস, মলদোভা, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনেগ্রো, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান, উগান্ডা, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, জাম্বিয়া। এ ছাড়া চীন, মেসেডোনিয়া, মাদাগাস্কার ও নেপালে নারী দিবসে শুধু নারীরাই সরকারি ছুটি পান।
নারী দিবস তো প্রতিবছর পালিত হচ্ছে। কিন্তু দিবসটি পালনের যে মূল উদ্দেশ্য, তা কি পূরণ হচ্ছে?
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকে এগিয়ে যাচ্ছেনও। কিন্তু অনেকে মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ছেন। কিছু অশুভ শক্তি কেমনভাবে যেন তাঁদের পেছন থেকে টেনে ধরছে। যার ফলে তাঁরা আর উঠতে পারেন না।
এখনো বিশ্বের বহু নারী তাঁদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। নারীরা নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশ্বের অনেক দেশে নারীর মজুরি পুরুষের তুলনায় কম। অথচ নারীরা পুরুষের তুলনায় কাজ করেন অনেক বেশি।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীরা পুরুষের তুলনায় বছরে গড়ে ৩৯ দিন বেশি কাজ করেন। নারী ও পুরুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হতে আরও ১৭০ বছর লেগে যাবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অবৈতনিক কাজগুলো বাধ্যতামূলকভাবে নারীদেরই করতে হয়। নারীর গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি এখনো দেওয়া হয়নি। অর্থনৈতিক মূল্যে তা অদৃশ্যই থাকে।
কি উন্নত কি অনুন্নত, সব দেশে নারীর অবস্থা প্রায় একই রকম। তাঁরা কোথাও ভালো নেই। তাঁরা এখনো ধর্ষণ, শ্লীলতাহানিসহ নানাভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। পুরুষেরা এখনো নারীদের তাঁদের অধস্তন মনে করেন। বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু নয়। এখানে বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশ এখনো স্বামীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। একুশ শতকের দুনিয়ায় নারীর এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পরিবর্তনের জন্য সাহসী হও’। আসলেই নারীদের অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। নারীর প্রতি সহিংসতা ও সব বৈষম্যমূলক আচরণের অবসানে নারীর একক প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে আরও অনেক কাজ করতে হবে। গুটি কয়েক আইন প্রণয়ন করেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আইনের প্রয়োগ হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্বও রাষ্ট্রের। নারীদের পেছন থেকে যারা টেনে ধরে রাখছে, সেই অশুভ শক্তিগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং পরাজিত করতে হবে।
আজকের নারী দিবস উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পালিত হচ্ছে নানা অনুষ্ঠান। দিবসটি যেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। আজ থেকেই শুরু হোক নারীর প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য নতুন করে লড়াই।