নিজের পরিচয় নিয়ে ছোটবেলা থেকে নানা পর্যায়ে হোঁচট খেতে শুরু করেন। সেই পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রও মেলেনি। তড়িৎকৌশলে ডিপ্লোমা পাস করার পরও শুধু পরিচয়ের কারণে কোনো চাকরি মেলেনি বলে মনে করেন। তবে যে হিজড়া পরিচয় নিয়ে এত বঞ্চনা, সেই পরিচয়েই স্বীকৃতি পেলেন ‘জয়িতা’ হয়ে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদে তাঁর নাম আরিফ। তবে সমাজে তিনি পরিচিত আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী হিসেবে। এ পরিচয়েই তিনি দেশে প্রথমবারের মতো হিজড়া সম্প্রদায় থেকে গত বছর ঢাকা বিভাগের ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ পুরস্কার পেয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে ‘জয়িতা’ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে নারীদের। ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠ পাঁচজনের মধ্যে তিনি একজন। তিনিই প্রথম হিজড়া হিসেবে এ পুরস্কার পেলেন।
গত বছর ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির হাত থেকে ক্রেস্ট ও সনদ নিয়েছেন আরিফা। ওই অনুষ্ঠানে তিনি সবাইকে গানও শুনিয়েছেন।
জামালপুরের আরিফা হিজড়াদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে ২০১৩ সালে জামালপুর সদরে ‘সিঁড়ি সমাজ-কল্যাণ সংস্থা’ নামের একটি সংগঠন তৈরি করেন। বর্তমানে তিনি এ সংগঠনের সভাপতি। সংগঠনের সদস্য ৮৭ জন হিজড়া। এর মধ্যে ১৫ জন হিজড়া এ সংগঠনে বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরি করছেন। এ জন্য তাঁরা পারিশ্রমিক পান। এতে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামক সংগঠন।
বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে ঢাকায় এসে গতকাল বুধবার আরিফা প্রথম আলো কার্যালয়ে আসেন। সঙ্গে জয়িতা পুরস্কারের ক্রেস্ট ও সনদ। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে তাঁর হাতে লেখা একটি আবেদনপত্র দেখালেন। জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান।
আরিফা বলেন, ‘বর্তমান সরকার তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে। সরকারের কাছ থেকে জয়িতা পুরস্কারের সম্মাননা পেয়েছি। কিন্তু শুধু স্বীকৃতি, সম্মাননা দিয়ে তো জীবন চলে না। হিজড়া বলে আমরা চাকরি পাই না। হিজড়া পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে পারি না। নিজের একটি সংগঠনের মাধ্যমে হিজড়াদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার সংগঠনই তো চলে না। হস্তশিল্পসামগ্রী কোনো মাসে বিক্রি হয়, কোনো মাসে বিক্রি হয় না।’ তিনি জানান, আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী নামেই জন্ম নিবন্ধন করেছেন। তবে হিজড়া পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে পারেননি। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে তড়িৎকৌশলে ডিপ্লোমা পাস করেছেন ২০১০ সালে। তাঁর মতে, যোগ্যতা থাকার পরও শুধু হিজড়া বলে কেউ চাকরি দিতে চায় না।
আরিফা জানান, অন্য হিজড়াদের তুলনায় তিনি পারিবারিকভাবে সুবিধাভোগী। তাঁর পরিবার তাঁকে তাড়িয়ে দেয়নি। তাই বলে সামাজিকভাবে যে বঞ্চনার শিকার হননি, তা নয়। বিয়ে বা যেকোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না, মানুষ বাজে গালি দেয়। ময়মনসিংহে পড়ার সময় মেসের অন্যদের অত্যাচারে সেখানে টিকতেই পারেননি। রাস্তাঘাটে বের হলে এখন পর্যন্ত বাজে গালি পিছু ছাড়ে না। বাবা বেঁচে নেই। আরিফাকে কেউ গালি দিয়েছে শুনলে মা শুধু কাঁদেন। পরিবারে দুই ভাই আছেন। তাঁদের সংসার রয়েছে।
ছোটবেলার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আরিফা বলেন, ‘বয়স তখন আট বছর হবে। বাবা ঈদের জামা কিনতে নিয়ে গেলেন। আমি ছেলেদের শার্ট না কিনে একটি ফ্রক কিনে বাড়ি ফিরলাম। বাবা কিছু না বললেও বড় ভাই খুব মার দিলেন। তারপর আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাই। এখন শাড়ি পরি।’
আরিফা বলেন, অনেক হিজড়া ভিক্ষাবৃত্তি করতে চায় না। তাদের জন্য সরকার যদি কোনো ব্যবস্থা নেয়, তাহলে সমাজের মানুষও বাঁচবে, হিজড়ারাও বাঁচবে। এখন তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।