রাতুল মন্ডল, শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি: দাদা থেকে শুরু করে বাবা, চাচাসহ পরিবারের কেউ শিক্ষিত নন বলে দুঃখ ছিল সহোদরা দুই বোনের। দুই বোনের দৃঢ় লক্ষ্যই ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার। দরিদ্র পরিবারের ওই দুই বোন তাদের লক্ষ্য পূরণের সুবিধার জন্য একই শ্রেণিতে পড়ত। কিন্তু বখাটে এক যুবকের কুনজর ওই দুই বোনের লক্ষ্য পূরণে বাধ সেধেছে। প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বখাটে যুবকটি ছবি কারসাজির মাধ্যমে এক বোনের অসংখ্য অশ্লীল ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) ছড়িয়ে দেয়। এতে লজ্জায়-ঘৃণায় ঘর থেকে বের হতে পারছে না মেয়েটি। ফেসবুকের মাধ্যমে হাতে হাতে বড় বোনের অশ্লীল ছবি ছড়িয়ে পড়ায় ছোট বোনটিও বিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছে।
ন্যক্কার এ ঘটনাটি ঘটেছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের সাতখামাইর গ্রামে। ওই দুই বোন পাশের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। তাদের বাবা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ছবি কারসাজি করা বখাটে যুবকের নাম মোখলেস (২১)। সে পাশের ডালেশহর পূর্বপাড়া বস্তির মঞ্জু মিয়ার ছেলে।
এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বড় ভাই বাদী হয়ে গত সোমবার রাতে শ্রীপুর মডেল থানায় অভিযোগ করেছেন। ঘটনার পর থেকে মোখলেস পলাতক রয়েছে।
জানা গেছে, প্রায় বছর খানেক আগে ওই ছাত্রীর ওপর মোখলেসের কুনজর পড়ে। বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে তাকে উত্ত্যক্ত করত মোখলেস। ঘটনা জেনে তার বড় ভাই প্রতিবাদ করলে কিছুদিন উত্ত্যক্ততা বন্ধ ছিল।
ওই ছাত্রী জানায়, কয়েকমাস আগে বিদ্যালয় যাওয়ার পথে মোখলেস তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। সে তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করলে মোখলেস তাকে ‘বেশি দেমাগ ভালো নয়’ বলে শাসায়। কয়েকদিন পর আবারো প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে তাকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছিল।
স্থানীয়রা জানায়, গত প্রায় মাস খানেক ধরে ফেসবুকের পৃথক তিনটি ফেক আইডি থেকে মেয়েটির একের পর এক অশ্লীল ছবি দিতে থাকে। প্রথমে ‘অভিশপ্ত ফেসবুক’ থেকে ছবি আপলোড করে। এর ৫/৬ দিন পর ‘তুর অভিশাপ’ (তোর অভিশাপ) থেকে আরো ছবি দেয়। তারও এক সপ্তাহ পর ঙঃৎরঢ়ঃড় অশযর আইডি থেকে দেওয়া হয় আরো কয়েকটি ছবি। মুহূর্তে ওই অশ্লীল ছবিগুলো হাতে-হাতে ছড়িয়ে পড়ে।
ছাত্রীর বড় ভাই জানান, মোখলেস কৌশলে তাঁর ছোট বোনের ছবি সংগ্রহ করে কারসাজি করে পর্ণমডেলদের সঙ্গেজুড়ে দিয়ে তা তার পৃথক তিনটি ফেক আইডি থেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। গত প্রায় ১০ থেকে ১২ দিন আগে তাঁরা ঘটনাটি জেনেছেন।
প্রতিবেশীরা জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ছবি ছড়িয়ে পড়ায় লজ্জায়-ঘৃণায় ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে ছাত্রীটি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও জেনে যাওয়ায় লজ্জায় মেয়েটির ছোট বোনও বিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছে।
ছাত্রীর মা জানান, ঘটনা জানার পর তাঁর বড় মেয়ে একবারও ঘর থেকে বের হয়নি। প্রতিমুহূর্ত বিছানায় পড়ে কাঁদছে। কয়েকদফা মূর্ছা গিয়েছে তাঁর মেয়ে। সহপাঠীরা ঘটনাটি জানতে চায় বলে ছোট মেয়েটিও বিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছে। তাঁর দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত হয়ে গেছে।
ছাত্রীর বাবা জানান, তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে ওই ছাত্রী মেঝো। বড় মেয়ে বিবাহিত। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি আরো জানান, তিনি কখনো বিদ্যালয়মুখী হননি। তাঁর বাবা ও ভাইদের কেউ-ই পড়ালেখা করেননি। তাঁর দুই ছেলেও দারিদ্রের কারণে বিদ্যালয়মুখী না হয়ে সংসারের হাল ধরেন। ফলে তাঁর দুই মেয়ের স্বপ্ন ছিল, তারা পড়ালেখা করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সরকারি কর্মকর্তা হবে। খরচ কমিয়ে পড়ালেখার জন্য দুই বোনই একই শ্রেণিতে পড়ত। কিন্তু তাদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই করে দিয়েছে বখাটে মোখলেস।
স্থানীয় বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। ঘটনার পর থেকে দুই বোন বিদ্যালয়ে আসছে না। যেকোনোভাবেই তাদের আমি বিদ্যালয়ে আনার উদ্যোগ নেব।’ তবে তিনি দাবি করেন, ‘ঘটনায় জড়িত ওই যুবকটির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।’
এ ঘটনায় গত সোমবার রাতে ছাত্রীর বড় ভাই বাদী হয়ে শ্রীপুর মডেল থানায় অভিযোগ করেছেন। তবে গতকাল বিকেলে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মামলা হয়নি।
শ্রীপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল হাসান বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে। এ ঘটনায় জড়িত মোখলেসকে গ্রেপ্তার করা হবে।’