ঢাকা; নির্বাচন এখনো বহুদূর। পাক্কা দুই বছর। কিন্তু কেমন হবে নির্বাচন। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখাই বা কী হবে! রাজনীতিতে এ নিয়ে চলছে চাপান-উতোর। বাহাসে জড়িয়ে পড়েছেন প্রধান দুই দলের নেতারা। চলছে কথার লড়াই। আক্রমণ। পাল্টা আক্রমণ।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সাফ কথা, নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই হবে। অন্যদিকে, বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রূপরেখা দেবেন খালেদা জিয়া। বিএনপি নেত্রীর মামলা নিয়েও বিতর্কে জড়িয়েছেন সরকার ও বিরোধী জোটের নেতারা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। মামলা দু’টির ফয়সালা দেখেই অনেকাংশে বোঝা যেতে পারে রাজনীতির ভবিষ্যৎ চিত্র।
গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এনপিপি’র এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে- সরকার জোর করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য করতে চাইছে। খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে একতরফা নির্বাচন দিতে চাইছে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠালে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ রাজধানীর হোটেল রেডিসনের সামনে একটি সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের উদ্বোধন করতে গিয়ে পরদিন ১৬ই ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার কিংবা জেলে পাঠানোর কোনো ভাবনা সরকারের নেই। আদালতে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে সে কারাগারে যাবে কি-না, সে মাফ পাবে কি-না সেটা আদালত বলতে পারবে। তবে সময় এবং স্রোত কারো জন্য যেমন অপেক্ষা করে না, তেমনি সংবিধান এবং নির্বাচনও কারো জন্য অপেক্ষা করবে না। আদালতে কেউ সাজাপ্রাপ্ত হলে নির্বাচন কারো জন্য বসে থাকবে না। যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ ১৬ই ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে বিদেশি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশে হলে বাংলাদেশে কেন হবে না। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে। নির্বাচনে এই সরকার সহায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে সরকার। এর ব্যতিক্রম হবে না। এখন মির্জা ফখরুলরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তারা নির্বাচনে আসবেন কি-না। বিএনপির নির্বাচন স্থগিত এবং বন্ধ করার ক্ষমতা নেই। ২০১৪ সালে সেটা প্রমাণিত হয়েছে।’ অন্যদিকে ১৭ই ফেব্রুয়ারি জার্মানির মিউনিখে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদি সত্যি কোর্টের কাছে এভিডেন্স থাকে চুরি করেছে, তাহলে শাস্তি হবে। সেজন্য তারা ইলেকশনই হতে দেবে না। একটা চোর… এতিমের টাকা যে চুরি করে খায় তাকে রক্ষার জন্য ইলেকশন হতে দেবে না। কত আবদারের কথা, কত আহ্লাদের কথা।’ একইদিন ১৭ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। বিএনপিসহ সবাইকে অনুরোধ করতে চাই, আগামী নির্বাচন যখন নির্ধারিত সময়ে হবে, বর্তমান সরকারের যিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন তার অধীনেই নির্বাচন হবে। এটা সব দেশেই হয়। এই অজুহাতে কোনোভাবেই নির্বাচন ব্যাহত করবেন না দয়া করে।’ একইদিন প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার ৭৫তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় সরকার প্রধান থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। গত নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। তাই বলে নির্বাচন থেমে থাকেনি, এবারো নির্বাচন থেমে থাকবে না।’ সেদিন বিকালেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের বক্তব্যের জবাব দেয় বিএনপি। দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, ‘ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে যে ষড়যন্ত্র ও অশুভ পরিকল্পনার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে তা কারো হৃদয়াঙ্গম করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। নির্বাচনে আস্থাশীল ও বিশ্বাসী একটি সংগঠন বিএনপি। এই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে দেশে কোনো নির্বাচন হতে পারবে না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচন করার যে কোনো অপচেষ্টা এদেশের জনগণ সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দেবে। সংবিধান কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ নয় যে, এটি সংশোধিত হতে পারবে না।’ পরদিন ভোলা জেলা বিএনপির ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আবারো বলছি, আমরা নির্বাচন চাই। তবে সে নির্বাচন অবশ্যই সব দলের অংশগ্রহণে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সে লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় তার জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন সময়ে একটি সহায়ক সরকার। আমরা খুব অল্প দিনের মধ্যে সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবো। এছাড়া খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়া যাবে না। তাহলে নির্বাচন বর্জন করবে বিএনপি।’ একইদিন ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের বিভাগীয় কর্মী সমাবেশে অংশ নিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটি ঠেকাতে পারবে না বিএনপি। এ নির্বাচনে বিএনপি অবশ্যই অংশগ্রহণ করবে, অন্যথায় তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ অন্যদিকে ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠির নলছিটি পৌর এলাকায় একটি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ জবাবে একইদিন তাঁতী দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘শেখ হাসিনার অধীনে যদি নির্বাচনেই যাবো, তাহলে ২০১৪ সালেই নির্বাচনে যেতে পারতাম। তাহলে পাঁচ বছর পরে যাবো কেন? বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না। আর খালেদা জিয়াকে ছাড়া কোনো নির্বাচনও হবে না।’ অবশ্যই একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক বাহাসের শুরুটা হয় একমাস আগে। জাতীয় সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গত ১৩ই জানুয়ারি বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে কিছু পূর্বশর্ত তুলে ধরেছিলেন। তিনি সেদিন বলেন, ‘একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ, সাহসী, যোগ্য নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন হতে হবে। সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত, বিরোধী দল নির্মূল করার যে প্রক্রিয়া বন্ধ, সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সভা, মিছিল, সমাবেশ করার সমান সুযোগ, গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতে হবে। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, রাজনীতিকে তার স্বাভাবিক পথে চলতে দিতে হবে।’ কয়েকদিন আগে খুলনায় এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখন আসছে আমাদের নির্বাচনকালীন সরকার। বৃহত্তম ও জনপ্রিয় দল হিসেবে বিএনপির গণতান্ত্রিক দায়িত্ব হচ্ছে জাতির সামনে নির্বাচনকালীন সরকার কী রূপ পাবে- সেটা আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা আসবে, সেই প্রস্তাবনা হবে মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্র।’