ঢাকা; বন্দি হলেও তো মা! তাঁর স্পর্শ থেকে যাতে সন্তান বঞ্চিত না হয়, সেই ব্যবস্থা করছে কারা দফতর।
এ বার থেকে জেলে এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হলে আর গরাদের ও-পার থেকে নয়— মায়ের পাশে বসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেই কথা বলতে পারবে ছেলেমেয়েরা। সম্প্রতি এমনই বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কারা দফতর। তাতে বলা হয়েছে, ‘সন্তানদের মায়ের ভালবাসার ছোঁয়া প্রয়োজন। মায়ের একটু ছোঁয়া কিংবা আদর শিশুদের কাছে তার পুরো জগৎ।’ দফতরের নির্দেশ, মহিলা কারারক্ষীর উপস্থিতিতে জেল-অফিসের মধ্যে এমন জায়গায় মায়ের সঙ্গে শিশুদের দেখা করার ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে শিশুরা কোনও অবস্থাতেই অস্বস্তিতে না পড়ে। সেটা শনি, রবি কিংবা ছুটির দিনে হলেই ভাল হয়। দেখা করার অনুমতি দেওয়ার অধিকার থাকবে সংশ্লিষ্ট জেলের সুপারের উপর। নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে তিনিই এ ব্যাপারে অনুমতি দেবেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে সন্তানের মনে জেল সম্পর্কে কোনও রকম নেতিবাচক প্রভাব যেন না পড়ে, খেয়াল রাখতে হবে তা-ও।
এত দিন পর্যন্ত কারা দফতরের বিধি অনুযায়ী, কোনও মহিলা বন্দির সন্তানের বয়স যদি ছ’বছরের কম হয়, তা হলে ওই শিশু মায়ের সঙ্গে জেলে থাকতে পারে। তার পরে তাকে পরিবারের কাছে ফিরে যেতে হয়। সে রকম সুবিধা না থাকলে তাকে কোনও হোমে পাঠানো হয়। ছ’বছরের বেশি বয়সী শিশুরা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এলে এত দিন গরাদের ও-পার থেকেই করতে হতো। নতুন নিয়মে সন্তানের বয়স ১৮ বছরের কম হলেই তারা জেলে এসে মায়ের কাছে বসে তাঁকে ছুঁয়ে কথা বলতে পারবে। দেখা করার মেয়াদ ১৫ মিনিট থেকে আধ ঘণ্টা।
কারা দফতর সূত্রের খবর, কলকাতার আলিপুর মহিলা সংশোধনাগারে ইতিমধ্যেই এই নির্দেশ কার্যকর করা শুরু হয়েছে। ওই জেলের এক কর্মী বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্ত জানতে পেরে মহিলা বন্দিদের মধ্যে সাড়া পড়ে গিয়েছে। সবাই এসে আমাদের জি়জ্ঞেস করছেন, আমরা তা হলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসতে বলব?’’ ওই কর্মী বলেন, ‘‘এই সে দিনই একটি মেয়ে পড়াশোনা করতে দিল্লি যাওয়ার আগে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। মা তাকে পরামর্শ দেবেন কী, সে-ই মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার সঙ্গে তো সবাই আছে। কিন্তু তুমি একা থাকো। সাবধানে থেকো। মা তখন অঝোরে কেঁদেই চলেছেন।’’কারা দফতরের এই সিদ্ধান্ত খুবই সাধুবাদযোগ্য বলে মনে করছেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। তাঁর মতে, ‘‘মায়ের সাহচর্য যে কোনও শিশুকেই পৃথিবী সম্পর্কে একটা আস্থা তৈরি করে দেয়। সদর্থক ভাবনা গড়ে ওঠে।’’ কিন্তু জেলের পরিবেশ বড় বয়সের শিশুর থাকার উপযুক্ত নয় বলেই ছ’বছরের পরে শিশুদের আর মায়ের সঙ্গে রাখা হয় না। এমতাবস্থায় কারা দফতরের নতুন নিয়ম খুবই উপযোগী হবে বলে মনে করছেন নীলাঞ্জনাদেবী। তাঁর কথায়, ‘‘মায়ের কাছে যাওয়া, তাঁর গায়ের গন্ধ— এই সব কিছুর মধ্যেই একটা নিশ্চয়তা বোধের হাতছানি রয়েছে।’’
শুধু মা কেন, বাবাদের জন্যও এমন নিয়ম হওয়া উচিত বলে মনে করেন রাজ্য কারা দফতরের প্রাক্তন আইজি বংশীধর শর্মা। তিনি বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েরা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারলে শুধু তারাই উপকৃত হবে না, মায়েদেরও ভাল লাগবে। আমি তো মনে করি, বাবাকেও তাঁর সন্তানদের আদর করার অধিকার দেওয়া উচিত। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই সাজাপ্রাপ্ত হলে তাঁদের একসঙ্গে জেলে রাখা উচিত।’’
জেলের সংশোধন প্রক্রিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে যুক্ত রয়েছেন নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়। তিনিও মনে করেন, সন্তানরা তো অপরাধী নয়। তাই মায়ের সঙ্গে দেখা করাটা তার অধিকার। তিনি বলেন, ‘‘এই যে বাচ্চারা এসে মায়ের কোলে বসছে, মা তাদের আদর করছে। তারাও মায়ের কাছে থাকছে। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য সংস্পর্শ পাচ্ছে— এর থেকে ভাল কিছু হতে পারে না।’’
সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা