ঢাকা; ‘সখি কেমনে বাঁধিব হিয়া’- এই কাতরতা আজ ঝরে পড়বে হিয়ার মাঝে। দশ দিগন্তে আলোর নাচন তুলে প্রতিদিনের মতো আজকের ভোরেও চোখ মেলবে চিরতরুণ সূর্য। হৃদয়বনে উতোল-চঞ্চল গুঞ্জরণ ছড়িয়ে দেবে দখিন হাওয়া। হৃদয়ে ফাল্গুনের আবীর-উচ্ছ্বাস। শীতের জড়তা কাটিয়ে মলিন প্রকৃতি যেমন জেগে ওঠে সবুজের সমারোহে, মানবহৃদয়ও তেমনি বসন্তে গেয়ে ওঠে চিরআরাধ্য ভালোবাসার জয়গান। ঋতুরাজ বসন্তের দ্বিতীয় দিনে আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে। সুন্দর জীবনের জন্য ভালোবাসা। সুখী জীবনের জন্যও ভালোবাসা। এই দিনে প্রিয় মানুষটিকে মনের গোপন কথা অকপটে বলার মাধ্যমে সূচিত হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। আর প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল অন্তহীন ভালোবাসায় বাকি জীবন ঘিরে থাকার শপথে বলীয়ান হয়। হাতে লাল গোলাপ, চোখে আনন্দময় আগামীর স্বপ্ন, মনে আনন্দ-উত্তেজনা। হাতে হাত রেখে বাকি জীবন কাটানোর প্রত্যয়। ভালোবাসার চাদরে জীবন ঢেকে থাকবে বলে কত শত পরিকল্পনা!
অমরাবতীর তীর ছুঁয়ে পালকে স্বর্ণরেণু মেখে উড়ে আসবে আজ ভালোবাসার বর্ণিল প্রজাপতি আর ভ্রমরের ঝাঁক। ‘যত গোপনে ভালোবাসি পরান ভরি/পরান ভরি উঠে শোভাতে/যেমন কালো মেঘে অরুণ-আলো লেগে/মাধুরী উঠে জেগে প্রভাতে’- গহিনের ভালোবাসা প্রকাশের দিন আজ। মনের যত গোপন বাসনা, অব্যক্ত কথা তার ডালপালা, পত্র-পল্লব মেলে ছড়িয়ে পড়বে বসন্তের উতোল মধুর হাওয়ায়। প্রাণে প্রাণে লাগবে দোলা, দখিনা বাতাসে বুক পেতে, চুপি চুপি বলার দিন- ‘সখী, ভালোবাসি তারে’। হৃদয় গহনে তারাপুঞ্জের মতো ফুটবে চণ্ডীদাসের সেই অনাদিকালের পদ- ‘দুঁহু তার দুঁহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া/অর্ধতিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া/সখি কেমনে বাঁধিব হিয়া।’ প্রেমিক মনে আকুতি ঝরবে- ‘তুমি কি দেবে না সাড়া প্রিয়া বলে যদি ডাকি?/ হেসে কি কবে না কথা হাত যদি হাতে রাখি’। শচীনকর্তার গানের মতোই বুকের আগল খুলে বলার দিন ‘শোনো গো দখিনো হাওয়া, প্রেম করেছি আমি’। চিরচেনা প্রাণের বসন্ত নতুন রং দিয়েছে আজ। প্রকৃতি সেজেছে ভালোবাসার রঙিন আবেশে। কচি পাতায় পাতায় লেগেছে রং। প্রিয়, এই তো সেই ক্ষণ, যে ক্ষণ ভালোবাসিবার। ‘ভালোবাসা’- চারটি বর্ণের ছোট এ শব্দকে ঘিরেই যেন পৃথিবীর সব ঘূর্ণিপাক। ‘ভালোবাসা’ এ চারটি অক্ষরের ব্যাপ্তি এত সুবিশাল যে, শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই একটিমাত্র শব্দের তাৎপর্য ও ব্যাপকতা এতই বিস্তৃত, জটিল, সারা জীবন ‘ভালোবাসা’র মানে খুঁজেও সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্যে- কাব্য-মহাকাব্যের অঙ্কে-সর্গে, কবিতা ও গানের পঙ্ক্তি-ছত্রে, গল্প-উপন্যাসের পাতায় পাতায় অঙ্কিত তার রূপ-রস। তবুও ফুরায়নি ভালোবাসার আবেদন। কোথায় যেন রয়ে গেছে অপূর্ণতা, পাওয়ার আকুতি তাই অনিঃশেষ। ভালোবাসার চিরন্তন আবেগে খেই হারিয়েছেন পৃথিবীর অসংখ্য রথী-মহারথী। কেউ বলেছেন, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ, প্রেমের বিরহ থাকে সমস্ত জীবন।’ আবার কেউ বলেছেন, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানী।’ কবিগুরুর ভাষায়, ‘তোমরা যে বল দিবস-রজনী, ভালোবাসা, ভালোবাসা, সখী ভালোবাসা কারে কয়। সে তো কেবলই যাতনা নয়।’ অনিল ভট্টাচার্য গানের ভাষায় বলেছেন, ‘আধোরাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, মনে পড়ে ওগো প্রিয়, চাঁদ হয়ে রবো আকাশেরও গায়, বাতায়ন খুলে দিও।’ ভালোবাসার এমন অসংখ্য পঙ্ক্তি রয়েছে। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা প্রকাশ করেছেন প্রিয় ও প্রেয়সীর পরস্পরের অন্তরের কথামালা। রজকিনীর সঙ্গে এক পলক চোখাচোখির জন্য শুকনো পুকুরে ১২ বছর ছিপ ফেলে বসে থেকেছেন চণ্ডিদাস। চণ্ডিদাসের ভাষায় ‘রজকিনী প্রেম-নিকষিত হেম।’ কথায় কথায় বলা হয় প্রেমের কাছে সবই তুচ্ছ। রূপকথা নয়, সিম্পসনের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে অষ্টম এডওয়ার্ড ছেড়েছিলেন সিংহাসন। স্বামী প্রিন্স আলবার্টের মৃত্যুর পর ৪০ বছর কালো পোশাক পরিধান করেছেন রাণী ভিক্টোরিয়া। প্রেমিকা আনারকলিকে পেতে পিতা মোগল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন শাহজাদা সেলিম। প্রেমিকের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন আনারকলি। বইয়ের পাতায় অথবা মানুষের মনে এই প্রাণোচ্ছল প্রেম, রাতের আকাশে ঝকমকে তারার মতোই উজ্জ্বল। কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে- ‘পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছুই নও, কিন্তু কারও কাছে তুমিই তার পৃথিবী’। আজ বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতা আর ভালোবাসার উৎসবে মুখর হবে জনপদ। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের গবেষকদের অনেকে বলে থাকেন, ফেব্রুয়ারির এই সময়ে পাখিরা তাদের জুটি খুঁজে বাসা বাঁধে। নিরাবরণ বৃক্ষে কচি কিশলয় জেগে ওঠে। সৌরভ ছড়ায় ফুল। বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে অনাদিকাল থেকেই যাপিত হচ্ছে বসন্ত উৎসব। সনাতন ধর্মআচারিরা দোলযাত্রা, বাসন্তী পূজা, হোলি উৎসবে প্রণয়কে মুখ্য করে রেখেছিল। প্রচারণা দাক্ষিণ্যে আমাদের বসন্ত উৎসবকে পাশ্চাত্য ভ্যালেন্টাইন ডে’র মোড়কে অধিকার করে নিয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়ার ১৪ই ফেব্রুয়ারির এই প্রেম উৎসব তারুণ্যের ভেতর এক অদেখা ভুবনের উত্তেজনা ছড়ায়। কয়েক শতাব্দী ধরেই এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে পাশ্চাত্য দুনিয়ায়। আমাদের দেশে প্রায় দুই দশক ধরে এ দিবস পালন করছে তরুণ-তরুণীরা। ওদিকে পাশ্চাত্যে সেই খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী থেকেই ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপিত হয়ে আসছে। এক্ষণে এটা বিরাট উৎসবের রূপ পাচ্ছে। যে ভালোবাসা দিবস ঘিরে সারা বিশ্বে আজ এত মাতামাতি, তার সূচনা হয়েছিল কোনো এক বেদনাবিধুর আখ্যানের ভেতর দিয়ে। গ্রিক ও রোমান উপকথার মতোই ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি নিয়ে ছড়িয়ে আছে বহু গল্প-কাহিনী। তার তিনটি এরকম- প্রথম গল্প: ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট ক্লডিয়াস দ্বিতীয় তার সৈন্যবাহিনীর সদস্যদের বিয়ে নিষিদ্ধ করেন। বিশপ ভ্যালেন্টাইন গোপনে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতেন বলে তার শাস্তি হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড। দ্বিতীয় গল্প: যুদ্ধে আহত সৈনিকদের চিকিৎসার অপরাধে রোমান সম্রাট গথিকাস ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দেন সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেন্টাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লিখে রেখে যান। চিঠির ওপর লেখেন ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে পালন করা শুরু করেন। তৃতীয় গল্প: রোমের চিকিৎসক তরুণ যাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিল নগর জেলারের দুহিতা। সেই থেকে জন্ম নিয়েছিল তাদের ভালোবাসার অমরগাথা। গল্প-গাথা যাই হোক, উৎসমূলের নায়ক ফাদার সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন এবং তার মৃত্যুর দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি। দীর্ঘ সময় নীরবে-নিভৃতে পালনের পর ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমের রাজা পপ জেলুসিয়াস দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশে গতকাল ছিল বাঙালির বসন্তবরণের দিন। বসন্ত আর ভালোবাসার এই সম্মিলিত আখ্যান প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনেও দিয়ে যায় অকৃত্রিম দোলা। বসন্তের আগুনরাঙা শিমূল-পলাশ ভালোবাসাকে সত্যিই রাঙিয়ে দেবে। যুগলদের মনের উচ্ছ্বাসকে বাড়িয়ে দেবে সহস্রগুণ। ললনাদের খোঁপায় খোঁপায় শোভা পাচ্ছে হলুদ গাঁদা, জুঁই, পারিজাত, মল্লিকাসহ নানা রঙিন ফুল। চারদিকে সাজসাজ রব আর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে এ দিনটি উদযাপন করবে তরুণ সমাজ। কয়েক বছর ধরে গিফট শপ, রেস্টুরেন্ট, ফ্যাশন হাউস এমনকি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে যেসব ছাড় ও সুবিধা দিচ্ছে তার হবে সদ্ব্যবহার। ভালোবাসের দিনে আজ ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠবে মোবাইল ফোন, বিনিময় হবে ভালোবাসার বার্তা, আদান-প্রদান হবে হৃদয়। ফেসবুকের মাধ্যমে দেশ দেশান্তরে পৌঁছে দেবেন ভালোবাসার অনুভূতি। ফুলের দোকানগুলোতে থাকবে ভিড়। চ্যানেলগুলো ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে আয়োজন করেছে অনুষ্ঠানমালা। বিভিন্ন স্থানে একাধিক সংগঠনের ব্যানারে বের হবে ভালোবাসার শোভাযাত্রা, র্যালি। তবে মর্মবাণী হচ্ছে ‘আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত উদার হও, পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করো।’ ১৪ই ফেব্রুয়ারি কেবল যে তরুণদের তা নয়, এদিনে পিতা-মাতা-সন্তানের ভালোবাসাও দিবসকে বড়মাত্রায় উদ্ভাসিত করে। বছরজুড়েই থাকবে ভালোবাসার অনন্ত বসন্ত। তবুও দিনটি যখন ভালোবাসার, প্রিয়জনকে নতুন করে ভালোবাসা নিবেদনের দিন; এই দিনে যেন সবাই শপথ করেন পরস্পরকে ভালোবাসার। শুধু মনের মানুষকে নয়; পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব- সবাই একে অপরকে ভালোবাসবে। এই দিনের অনুরাগ নিয়ে পুরো পৃথিবী আমরা ঢেকে দেবো ভালোবাসার অবিচ্ছিন্ন ফুলেল চাদরে। যেখানে থাকবে না ব্যক্তিগত হানাহানি, বৈষম্য, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে দাঙ্গা আর এক রাষ্ট্রের ওপর অন্য রাষ্ট্রের নোংরা দখলবাজি। হৃদ্যতা আর অপরিসীম মমত্ব প্রদর্শনের এই দিনের মতো সারা বছরই যেন আমরা থাকতে পারি ভালোবাসায়। আসুন ভুলে যাই পেছনের সব দুঃখমাখা অতীত, ক্লেদ আর অপ্রাপ্তির হিসাব। নতুন করে শুরু করি সবকিছু, বুনি নতুন স্বপ্নের বীজ।