রঙ লাগালে বনে বনে, ঢেউ জাগালে সমীরণে, আজ ভুবনের দুয়ার খোলা, দোল দিয়েছে বনের দোলা’- আজ পহেলা ফাল্গুন। ১৪২৩ বঙ্গাব্দের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিন। প্রকৃতি আজ খুলে দেবে দখিন দুয়ার। বইবে ফাগুনের মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়া। নতুন করে জেগে উঠা, নতুন আনন্দে-আশায় রঙিন হয়ে ওঠার আবাহনে সে হাওয়া গাইবে- ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল/ স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল, দ্বার খোল দ্বার খোল।’ কদিন ধরেই আকাশের রং হয়ে উঠেছে নীল। ’ বাংলার প্রকৃতিতে আজ ফাগুনের ছোঁয়া, আগুনরাঙা বসন্তের মোহময় সুর। হিম-কুয়াশায় ঢাকা শীতের পর রুক্ষ মৃতপ্রায় নিসর্গে উষ্ণতার স্পর্শ দিয়ে জীবনের স্পন্দন ফিরিয়ে এনেছে আজ বসন্ত। বরং বেশিই প্রাকৃতিক রূপ-রসে, কোকিলের কুহুতান, আমের মুকুলের সৌরভে আর পিঠাপুলির মৌতাতে বসন্তের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। বসন্তের রঙিনদোলা, উচ্ছলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হবে- ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে/ ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে/ আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।’ বসন্ত মানেই চোখ-ধাঁধানো ফুলের সমাহার। পয়লা ফাল্গুনে কেবলই উঁকি দেয় সে রাঙা সম্ভাবনা। যারা মনভোলা, যারা অলস তাদের জাগাতে তাই সকলে স্মরণ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের তাতানো পঙ্ক্তি- ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক/আজ বসন্ত।’ অবশ্যই পলাশ-শিমুলের অভাব ঘুচিয়ে দেয় হলুদ গাঁদা। বসন্ত মানেই সুন্দরের আহ্বান, জীবনের জয়গান। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। দখিনা হাওয়ার টানে ধূসর প্রকৃতি জাগবে প্রাণের সাড়ায়। পাতাঝরা গাছের শাখায় শাখায় উঁকি দেবে কচি কচি নতুন পাতা। প্রকৃতি সাজবে নতুনরূপে। শীতের খোলসে ঢুকে থাকা পলাশ, শিমূল, কাঞ্চন, পারিজাত, মাধবী, কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া জেগে উঠবে অলৌকিক স্পর্শে। প্রকৃতিতে নৈসর্গিক প্রাণ ও রূপের আগমনে গুঞ্জন তুলবে ভ্রমর। গাছে গাছে ছড়িয়ে পড়বে পলাশ আর শিমূলের রূপের আগুন। আজ কেবলই শুরু, পাতার আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে কুহু কুহু ডাকে হৃদয় উচাটন করে তুলবে বসন্তের দূত কোকিল। আকুল ব্যাকুল করে তুলবে বিরহী অন্তর। নিসর্গের বর্ণচ্ছটায় প্রকৃতি হয়ে উঠবে বাঙ্ঘময়। ফাল্গুনের রঙিন স্পর্শে হিন্দোলিত হয়ে অন্তর গেয়ে উঠবে- ‘আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…।’ বসন্ত কেবল একটি ঋতুই নয়। আমাদের নতুন করে জেগে উঠার, বেঁচে থাকার গূঢ় প্রেরণা বসন্তকাল। সকল কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ-ব্যর্থতা ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাবার বার্তাবহ। বসন্ত এলে বনের নিভৃত কোণে, মেঠোপথের ধারে কারও দেখার অপেক্ষা না করেই ফোটে কত নাম না-জানা ফুল। যেমন মানবজীবন। সে জন্যই কবিহৃদয় গেয়ে উঠে- ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে/ ময়ূরের মতো নাচেরে।’ প্রেমের ঋতু বসন্তে প্রেমিক মন আনমনে গেয়ে উঠবে- ‘শোন গো দখিনা হাওয়া/প্রেম করেছি আমি…।’ বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায়। বিশেষত কবিতা ও গানে ফাল্গুন আর বসন্তের রূপ চিত্রিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে নানা অনুষঙ্গে- অনুপ্রাস, উপমা, উৎপ্রেক্ষায়। কাজী নজরুল ইসলাম বসন্তের আগমনীতে গেয়েছেন- ‘বসন্ত এলো এলো এলো রে, পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহরে মুহু মুহু কুহু কুহু তানে।’ বাংলার ঘরে ঘরে উচ্চারিত একটি বাউল গান- ‘নারী হয় লজ্জাতে লাল, ফাল্গুনে লাল শিমূল বন, এ কোন রঙে রঙিন হলো বাউল মন… মন রে…’। কিংবা ভাটিবাংলার গান- ‘বসন্ত বাতাসে…সই গো/ বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে…।’ আমাদের দেশে ফাল্গুন শব্দের পাশাপাশি বসন্ত শব্দের রয়েছে নানাবিধ ব্যবহার। যেমন, যৌবনের তেজ বুঝাতে বলা হয় ‘ফাগুনের আগুন’, প্রেমিকভাবকে ইঙ্গিত করে টিপ্পিনি কাটা হয় ‘বসন্তের বাতাস’। পুরো বসন্তকালে সারা দেশে বসবে তিন শতাধিক গ্রামীণ মেলা। লোক-কারুশিল্প পণ্য ছাড়াও এসব মেলায় বাহারি পসরা সাজানো হয়। গ্রাম-বাংলায় বিশেষ আয়োজনে চলে পিঠা উৎসব। কৃষির সঙ্গেও দারুণ যোগসূত্র রয়েছে ফাল্গুনের। ‘যদি বর্ষে ফাল্গুনে/চীনা কাউন দ্বিগুণে’, ‘ফালগুনে গুড় আদা, বেল, পিঠা/খেতে বড় মিঠা’- এমন অনেক খনার বচন রচিত হয়েছে বসন্তকে ঘিরে। ফাল্গুনের দেয়ালে পিঠ রেখে কৃষক অপেক্ষার চোখ রাখে চৈতালী ফসলের পানে। মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে বাংলা নবববর্ষ গণনা শুরুর পর নতুন বছরকে কেন্দ্র করে প্রবর্তন করেছিলেন ১৪টি উৎসবের। তার অন্যতম এ বসন্ত উৎসব। ১৪০১ বঙ্গাব্দ থেকে বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিনে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন শুরু হয়। বাঙালির নিজস্ব সর্বজনীন প্রাণের উৎসবের মাঝে এ উৎসব এখন গোটা বাঙালির কাছে ব্যাপক সমাদৃত। এ উৎসব পরিণত হয়েছে প্রাণ ও প্রেমের উৎসবে। প্রতিবারের মতো এবারো বসন্ত বরণে নিয়েছে নানা প্রস্তুতি নিয়েছে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ। চারুকলার বকুলতলায় এবারো জমবে বসন্তবরণের উৎসব। ভোর থেকে শুরু হবে উৎসব। প্রথমে বসন্ত শোভাযাত্রা। তারপর দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় থাকবে শাস্ত্রীয় সংগীত, বসন্তবন্দনা, ফুলের প্রীতিবন্ধনী বিনিময়, আবৃত্তি, সংগীত, বাউল সংগীতসহ রয়েছে নানা আয়োজন। এছাড়াও শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডি লেক, রবীন্দ্র সরোবর, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বনানী লেক, বলধা গার্ডেন ও বাহাদুর শাহ পার্কসহ অনেক জায়গায় দিনভর চলবে বসন্তের উৎসব। দিনভর চলবে তরুণ-তরুণীদের বসন্তের উচ্ছ্বাস আর আনন্দ। মোবাইল ফোন, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলবে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়। ফুলেল বসন্ত, মধুময় বসন্ত, যৌবনের উদ্দামতা বয়ে আনা বসন্ত, আনন্দ-উচ্ছ্বাস-উদ্বেলতায় মন-প্রাণ কেড়ে নেয়া বসন্ত- তোমায় আবারো অভিবাদন। ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা/এসো হে এসো, হে এসো হে আমার বসন্ত’।