ঢাকা; সাতখুনের রায়ের পর আলোচনায় চাঞ্চল্যকর ৫ হত্যা মামলা। এই হত্যাগুলোর বিচার দ্রুত না হলে আরো হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। তাছাড়া চাঞ্চল্যকর পাঁচটি হত্যার বিচার না হওয়াতেই সাতখুনের মতো নৃশংস ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এমনটাই বলে আসছেন নারায়ণগঞ্জবাসী। এদিকে ৫টি হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশা দেখছেন স্বজনরা। তারা মনে করছেন, সরকারের সদিচ্ছা ছিল বলেই সাত খুনের ঘটনার দুই বছর নয় মাসের মাথায় বিচার সম্পন্ন হয়েছে। একইভাবে সরকার চাইলে বা প্রধানমন্ত্রীর স্বদিচ্ছা হলেই ৫টি হত্যারও সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার সম্ভব। নয় তো না। তবে পাঁচ মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে, মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী ও ব্যবসায়ী ভুলু সাহা হত্যা মামলার বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থাগুলো অনেক দিন ধরেই রহস্যজনকভাবে নিষ্ক্রিয়। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হতে পারে, সে বিষয়েও নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। অপর তিনটি মামলায় সংস্কৃতিকর্মী দিদারুল আলম (চঞ্চল), ব্যবসায়ী আশিক ইসলাম ও ছাত্রলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম (মিঠু) হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হলেও তাতে প্রকৃত আসামিদের নাম আসেনি বলে অভিযোগ করেছেন মামলাগুলোর বাদীরা। এজন্য তিন মামলায়ই বাদীরা আদালতে নারাজি দিয়েছেন। এরপর সেভাবেই পড়ে রয়েছে মামলা তিনটি।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের অভিযোগ, এই পাঁচ হত্যার সঙ্গেই জেলার প্রভাবশালী পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যের নাম আসায় মামলার তদন্ত ঠিকভাবে হয়নি। সাত খুনের মামলার রায়ের পর পরিবারগুলো এখন সরকারের দিকে চেয়ে আছে। তাদের আশা, তাদের স্বজন হত্যার মামলাগুলো নতুন করে সুষ্ঠু তদন্তের উদ্যোগ নেবে সরকার।
নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী বলেন, ত্বকী হত্যায় গ্রেপ্তারকৃত সুলতান শওকত ভ্রমর ২০১৩ সালের ১২ই নভেম্বর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, ৬ই মার্চ ২০১৩ রাত ৯টায় আজমেরী ওসমানের গাড়িতে করে ত্বকীকে আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আজমেরীর উপস্থিতিতে তারই নির্দেশে তারা ত্বকীকে হত্যায় অংশ নেয়। হত্যার পর তারা আজমেরীর গাড়িতে করেই ত্বকীর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। ২০১৪ সালের ৫ই মার্চ র?্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন ‘আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১জন ত্বকীকে হত্যা করেছে।’ তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের সে হত্যার একটি খসড়া অভিযোগপত্রও প্রদান করেন এবং অচিরেই তা আদালতে পেশ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু আজও পর্যন্ত সে অভিযোগপত্র প্রদান করা হয়নি।
অন্য চারটি হত্যা মামলার মধ্যে চঞ্চল হত্যা মামলায় পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেয়ার পর মামলাটি ঝুলে আছে। চঞ্চলের বড় ভাই জোবায়ের ইসলাম পমেল জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় দেয়া জবানবন্দির সময় জনৈক আফরিনের নাম আসে এবং উক্ত আফরিন চঞ্চলের বিপদ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এ ছাড়াও চার্জশিটে বিভিন্ন বিষয় ত্রুটিপূর্ণ রয়েছে। মোট কথা কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়া, নতুন কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার ছাড়া, কারো জবানবন্দি না নিয়ে একটা মনগড়া চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তিন বছর আগে আমাদের দেয়া অভিযোগই হুবহু চার্জশিটে তুলে ধরা হয়েছে। এ চার্জশিট দেখে পরিবারের সবাই হতাশ। এখন ‘জানি না এই মামলার বিচার পাব কি না। কিন্তু ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। আশা রাখতে চাই।’
ভুলু সাহা হত্যার তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান জানান, ২০১২ সালে ভুলু সাহাকে হত্যা করা হয়। তখন তিনি এই থানায় ছিলেন না। তাই নথি না দেখে মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলতে পারছেন না। তবে সদর থানার অপর এক কর্মকর্তা জানান, ভুলু হত্যার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই।
নারায়ণগঞ্জে আদালত পরিদর্শক সোহেল হোসেন জানান, মিঠু হত্যা মামলার বাদী তাঁর বাবা মারা গেছেন। মা-ও মারা গেছেন। ফলে বলা যায়, মামলাটি চালানোর মতো কেউ নেই। আর চঞ্চল ও আশিক হত্যার নারাজি আদালতে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ফলে নারাজির বিষয়ে আদালতের কোনো নির্দেশনা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সন্ত্রাস নির্মল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি আরো বলেন, আশিক, ত্বকী, চঞ্চল, মিঠু ও ভুলু এই ৫টি হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের প্রতি। তারা অভিযুক্ত থাকার কারণেই এই হত্যাকাণ্ডগুলির তদন্ত ও বিচারটা সঠিক পথে এগুচ্ছে না। সাতখুন মামলার রায়ে আবার যেটা প্রমাণ হলো যদি সরকার চায় কোনো অপরাধের বিচার করবে তাহলে তারা সেটা করতে পারে। সাতখুন জটিল একটা প্রক্রিয়া ছিল। এবং এই জটিল মামলাটা তারা মাত্র ৩২ মাসের মধ্যে ৩৮ কর্মদিবসে কিন্তু সম্পন্ন করেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা হচ্ছে তারা যদি চায় সেটা পারে। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু প্রথম দিকে ঘোষণা দিয়েছিল এটা আমরা যেভাবেই সম্পন্ন করবো। এবং সেই জন্য হয়েছে। তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) স্বদিচ্ছার কারণে। ত্বকী হত্যাসহ অন্য যে মামলাগুলির বিষয়ে তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) স্বদিচ্ছা নাই। তাছাড়া স্বদিচ্ছা আছে বলে আমরা সেটা মনে করছি না। বরং আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, যেই অভিযুক্ত পরিবার সেই পরিবারের পক্ষে পাশে থাকার ঘোষণার কারণে ত্বকী হত্যা মামলার যে অগ্রগতি তা একটা পর্যায় থেমে যায়। পরবর্তীতে পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি প্রধানমন্ত্রীর বোধোদয় হয়েছে যে, তিনি এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার করতে চান। এবং অভিযুক্ত পরিবারের সমস্ত অপরাধের বিচার করবেন বলে জানতে পেরেছি। এখন বিষয়টা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, যদি প্রধানমন্ত্রী চান এই হত্যাকাণ্ডগুলির বিচার হবে, তাহলেই হবে। মোট কথা সরকারের স্বদিচ্ছা এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই বিচার হবে না।
এদিকে গত সোমবার আলোচিত সাতখুন মামলায় এ্যালিট ফোর্স র্যাবের ৩ কর্মকর্তা ও নুর হোসেনসহ ২৬ জনের ফাঁসি ও ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে বিচার সম্পন্ন হওয়ায় ৫টি হত্যা মামলার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিচার পাওয়ায় আশায় রয়েছেন।
সেভেন মার্ডার: রায়ের কপির জন্য আবেদন, হাতে পেলেই আপিল
এদিকে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডার মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা রায়ের কপির জন্য আবেদন করলেও ১৮ই জানুয়ারি বুধবার বিকাল পর্যন্ত সে কপি সরবরাহ করা হয়নি। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, কপি পেলেই তারা নিয়মমাফিক উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। সোমবার নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালত ওই রায় ঘোষণা করেন যেখানে ২৬জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়।
রায়ের তিনদিন পেরুলেও বুধবার সে কপি তৈরি হয়নি জানিয়েছেন জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন। তিনি জানান, প্রস্তুতের কাজ চলছে। শেষ হলেই দেয়া হবে।
মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সাতখুনের প্রধান আসামি নুর হোসেনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খোকন সাহা জানান, আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফায়েড কপির জন্য অপেক্ষা করছি। ইতিমধ্যে সেটার জন্য আবেদন করেছি। সেটা হাতে পেলেই যথাযথ নিয়মে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেক বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সকলেই রায়ের আদেশের নকলের জন্য আবেদন করেছেন। তবে আমরা এখনো রায়ের আদেশের কপি নকলখানায় বুঝে পাইনি। নকল বুঝে পাওয়ার ৭ কর্মদিবসের মধ্যে আসামিদের আপিল করতে হবে। এছাড়া নিম্ন আদালতের এলসিআল (রায় এবং রায়ের আদেশ) ও ডেথ রেফারেন্স মহামান্য হাইকোর্টে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২৬ জন
মৃত্যুদণ্ড আসামিরা হলো- গ্রেপ্তার থাকা প্রধান আসামি নাসিক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দ বালা, র্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নুর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল। পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো- নুর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামালউদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, আলামিন শরিফ, তাজুল ইসলাম, এনামুল কবীর। এসব আসামির বিরুদ্ধে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ জন
অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর, কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের অভিযোগ, এই পাঁচ হত্যার সঙ্গেই জেলার প্রভাবশালী পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যের নাম আসায় মামলার তদন্ত ঠিকভাবে হয়নি। সাত খুনের মামলার রায়ের পর পরিবারগুলো এখন সরকারের দিকে চেয়ে আছে। তাদের আশা, তাদের স্বজন হত্যার মামলাগুলো নতুন করে সুষ্ঠু তদন্তের উদ্যোগ নেবে সরকার।
নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী বলেন, ত্বকী হত্যায় গ্রেপ্তারকৃত সুলতান শওকত ভ্রমর ২০১৩ সালের ১২ই নভেম্বর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, ৬ই মার্চ ২০১৩ রাত ৯টায় আজমেরী ওসমানের গাড়িতে করে ত্বকীকে আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আজমেরীর উপস্থিতিতে তারই নির্দেশে তারা ত্বকীকে হত্যায় অংশ নেয়। হত্যার পর তারা আজমেরীর গাড়িতে করেই ত্বকীর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। ২০১৪ সালের ৫ই মার্চ র?্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন ‘আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১জন ত্বকীকে হত্যা করেছে।’ তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের সে হত্যার একটি খসড়া অভিযোগপত্রও প্রদান করেন এবং অচিরেই তা আদালতে পেশ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু আজও পর্যন্ত সে অভিযোগপত্র প্রদান করা হয়নি।
অন্য চারটি হত্যা মামলার মধ্যে চঞ্চল হত্যা মামলায় পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেয়ার পর মামলাটি ঝুলে আছে। চঞ্চলের বড় ভাই জোবায়ের ইসলাম পমেল জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় দেয়া জবানবন্দির সময় জনৈক আফরিনের নাম আসে এবং উক্ত আফরিন চঞ্চলের বিপদ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এ ছাড়াও চার্জশিটে বিভিন্ন বিষয় ত্রুটিপূর্ণ রয়েছে। মোট কথা কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়া, নতুন কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার ছাড়া, কারো জবানবন্দি না নিয়ে একটা মনগড়া চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তিন বছর আগে আমাদের দেয়া অভিযোগই হুবহু চার্জশিটে তুলে ধরা হয়েছে। এ চার্জশিট দেখে পরিবারের সবাই হতাশ। এখন ‘জানি না এই মামলার বিচার পাব কি না। কিন্তু ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। আশা রাখতে চাই।’
ভুলু সাহা হত্যার তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান জানান, ২০১২ সালে ভুলু সাহাকে হত্যা করা হয়। তখন তিনি এই থানায় ছিলেন না। তাই নথি না দেখে মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলতে পারছেন না। তবে সদর থানার অপর এক কর্মকর্তা জানান, ভুলু হত্যার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই।
নারায়ণগঞ্জে আদালত পরিদর্শক সোহেল হোসেন জানান, মিঠু হত্যা মামলার বাদী তাঁর বাবা মারা গেছেন। মা-ও মারা গেছেন। ফলে বলা যায়, মামলাটি চালানোর মতো কেউ নেই। আর চঞ্চল ও আশিক হত্যার নারাজি আদালতে শুনানির অপেক্ষায় আছে। ফলে নারাজির বিষয়ে আদালতের কোনো নির্দেশনা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সন্ত্রাস নির্মল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি আরো বলেন, আশিক, ত্বকী, চঞ্চল, মিঠু ও ভুলু এই ৫টি হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের প্রতি। তারা অভিযুক্ত থাকার কারণেই এই হত্যাকাণ্ডগুলির তদন্ত ও বিচারটা সঠিক পথে এগুচ্ছে না। সাতখুন মামলার রায়ে আবার যেটা প্রমাণ হলো যদি সরকার চায় কোনো অপরাধের বিচার করবে তাহলে তারা সেটা করতে পারে। সাতখুন জটিল একটা প্রক্রিয়া ছিল। এবং এই জটিল মামলাটা তারা মাত্র ৩২ মাসের মধ্যে ৩৮ কর্মদিবসে কিন্তু সম্পন্ন করেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা হচ্ছে তারা যদি চায় সেটা পারে। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু প্রথম দিকে ঘোষণা দিয়েছিল এটা আমরা যেভাবেই সম্পন্ন করবো। এবং সেই জন্য হয়েছে। তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) স্বদিচ্ছার কারণে। ত্বকী হত্যাসহ অন্য যে মামলাগুলির বিষয়ে তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) স্বদিচ্ছা নাই। তাছাড়া স্বদিচ্ছা আছে বলে আমরা সেটা মনে করছি না। বরং আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, যেই অভিযুক্ত পরিবার সেই পরিবারের পক্ষে পাশে থাকার ঘোষণার কারণে ত্বকী হত্যা মামলার যে অগ্রগতি তা একটা পর্যায় থেমে যায়। পরবর্তীতে পত্রিকার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি প্রধানমন্ত্রীর বোধোদয় হয়েছে যে, তিনি এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার করতে চান। এবং অভিযুক্ত পরিবারের সমস্ত অপরাধের বিচার করবেন বলে জানতে পেরেছি। এখন বিষয়টা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, যদি প্রধানমন্ত্রী চান এই হত্যাকাণ্ডগুলির বিচার হবে, তাহলেই হবে। মোট কথা সরকারের স্বদিচ্ছা এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই বিচার হবে না।
এদিকে গত সোমবার আলোচিত সাতখুন মামলায় এ্যালিট ফোর্স র্যাবের ৩ কর্মকর্তা ও নুর হোসেনসহ ২৬ জনের ফাঁসি ও ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের মধ্য দিয়ে বিচার সম্পন্ন হওয়ায় ৫টি হত্যা মামলার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিচার পাওয়ায় আশায় রয়েছেন।
সেভেন মার্ডার: রায়ের কপির জন্য আবেদন, হাতে পেলেই আপিল
এদিকে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডার মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা রায়ের কপির জন্য আবেদন করলেও ১৮ই জানুয়ারি বুধবার বিকাল পর্যন্ত সে কপি সরবরাহ করা হয়নি। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, কপি পেলেই তারা নিয়মমাফিক উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। সোমবার নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালত ওই রায় ঘোষণা করেন যেখানে ২৬জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়।
রায়ের তিনদিন পেরুলেও বুধবার সে কপি তৈরি হয়নি জানিয়েছেন জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন। তিনি জানান, প্রস্তুতের কাজ চলছে। শেষ হলেই দেয়া হবে।
মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সাতখুনের প্রধান আসামি নুর হোসেনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খোকন সাহা জানান, আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফায়েড কপির জন্য অপেক্ষা করছি। ইতিমধ্যে সেটার জন্য আবেদন করেছি। সেটা হাতে পেলেই যথাযথ নিয়মে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেক বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সকলেই রায়ের আদেশের নকলের জন্য আবেদন করেছেন। তবে আমরা এখনো রায়ের আদেশের কপি নকলখানায় বুঝে পাইনি। নকল বুঝে পাওয়ার ৭ কর্মদিবসের মধ্যে আসামিদের আপিল করতে হবে। এছাড়া নিম্ন আদালতের এলসিআল (রায় এবং রায়ের আদেশ) ও ডেথ রেফারেন্স মহামান্য হাইকোর্টে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২৬ জন
মৃত্যুদণ্ড আসামিরা হলো- গ্রেপ্তার থাকা প্রধান আসামি নাসিক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দ বালা, র্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নুর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল। পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো- নুর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামালউদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, আলামিন শরিফ, তাজুল ইসলাম, এনামুল কবীর। এসব আসামির বিরুদ্ধে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ জন
অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর, কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে।