ঢাকা; গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে আবারও ১৪টি প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার আট পরিচালক দলগুলোর নেতৃত্ব দেবেন।
দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান বিভাগের মহাপরিচালকের তত্ত্বাবধানে এসব দল কাজ করলেও সংস্থার মহাপরিচালক মুনির চৌধুরী এসব দলের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন বলে জানা গেছে। গঠিত তিন সদস্যের ওই সব দলে একজন করে উপরিচালক ও সহকারী পরিচালক রয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (ওসিএজি), বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিমান, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট, আয়কর বিভাগ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি), ঢাকা ওয়াসা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং ঢাকা মহানগরের সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।
দুদকের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে মনে করছেন দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ উদ্যোগ থেকে সুফল আসবে বলে মানুষ আশা করে।
১১ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানিয়েছিলেন, চলতি বছর দুর্নীতিপ্রবণ দপ্তরগুলোতে বিশেষ নজরদারি করবে তাঁর সংস্থা। সেটা শিগগিরই দৃশ্যমান হবে। এরই ধারাবাহিকতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিপ্রবণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত। সাধারণ মানুষের এ ধারণা এবং নানা ধরনের হয়রানি ও ভোগান্তির অভিযোগ দুদকে এসেছে। দুদকের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কিছু প্রতিষ্ঠানের দুর্বল আইন, নীতিমালার ফাঁকফোকরসহ নানা সুযোগে দুর্নীতি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সেবাবঞ্চিত হচ্ছে। সেসব ভোগান্তির লাঘবে নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলো গঠন করা হয়েছে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে নিশ্চিত করে বলেন, কমিশন আজ বুধবার এ-সংক্রান্ত অনুমোদন দিয়ে আদেশ জারি করেছে। আদেশে দলগুলোর কার্যপরিধি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলো সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের আইন, বিধিবিধান পর্যালোচনা করে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে সুপারিশ করবে। তিনি বলেন, কমিশনের লক্ষ্য দুর্নীতির সূত্র খুঁজে বের করা। কিছু প্রতিষ্ঠানকে মানুষ কেন দুর্নীতিপ্রবণ হিসেবে মনে করে, তা খুঁজে দেখতে চাই। নিয়মনীতি বা প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে দুর্নীতি হচ্ছে কি না, সেটাও খুঁজে দেখা হবে। পাশাপাশি দুর্নীতির তথ্য পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদক সূত্র জানায়, প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আইন, বিধি, পরিচালনার পদ্ধতি এবং ওই সব প্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থ অপচয়ের দিকগুলো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক, নাগরিক সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা, সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি, দুর্নীতির কারণ ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে। সার্বিক বিশ্লেষণসহ দলের প্রতিবেদন ও সুপারিশ ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনে জমা দেবে দলগুলো। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলোর মেয়াদকালে ওই সব প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে সেগুলো আলাদাভাবে অনুসন্ধান করা হবে।
এর আগে ২০১২ সালে সরকারের ১১টি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি প্রতিরোধে ১১ জন উপপরিচালকের নেতৃত্বে ১১টি দল গঠন করেছিল দুদক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), ঢাকা সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সরকারি আবাসন পরিদপ্তর, সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের দুর্নীতি অনুসন্ধান ও প্রতিরোধে গঠিত দুদকের দলগুলো এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়। অনেকগুলো মামলাও করে। পরে দলগুলো সম্পর্কে নানা অভিযোগ ওঠায় প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলো ভেঙে দেওয়া হয়।
পরে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে দুজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে দুটি আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করে দুদক। টাস্কফোর্স দুটিও সেভাবে কার্যকর না হওয়ায় সেগুলো বাতিল করে গত বছরের ১৫ মে রাজউক, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে নজরদারির জন্য পাঁচটি বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করা হয়। সে সময় পাঁচজন পরিচালককে দলগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
জানা গেছে, মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট এবং আয়কর বিভাগ; সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ বিমান; মো. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে ওসিএজি অফিস; খন্দকার এনামুল বাছিরের নেতৃত্বে বিআরটিএ এবং ঢাকা মহানগরের সব সাবরেজিস্ট্রি অফিস; এ কে এম জায়েদ হোসেন খানের নেতৃত্বে রেলওয়ে এবং তিতাস গ্যাস; বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে ওয়াসা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর; সরদার মঞ্জুর আহমদের নেতৃত্বে বিআইডব্লিউটিএ এবং বিআইডব্লিউটিসি ও কাজী শফিকুল আলমের নেতৃত্বে সওজ এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরে নজরদারি চলবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ আগেও নেওয়া হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হবে বলে তিনি আশা করেন। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের কিছু কিছু কর্মকর্তা নিয়ে প্রশ্ন নানা সময় উঠেছে। এ বিষয়ে দুদক নিজেও কথা বলছে। তাই মনে রাখতে হবে, যে ক্ষমতা কর্মকর্তারা পাচ্ছেন, তার যেন অপব্যবহার না হয়। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সংস্থাটিকে। ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, দুদকের এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো দুর্নীতিবাজদের বার্তা দেওয়া। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, যাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠাগুলোর কাজের গতিশীলতা বাধাগ্রস্ত না হয়। সবচেয়ে ভালো হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা, তাতেই ভালো ফল আসবে।