ঢাকা; বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এ এস এফ রহমান এবং ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানদের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির আলোচিত দুই মামলা বাতিল করা হয়েছে। এ দুই মামলায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুর হোল্ডিংস, ব্যক্তি হিসেবে এ এস এফ রহমান, সালমান এফ রহমান ছাড়াও এ বি সিদ্দিকুর রহমান ও ডি এইচ খান (মৃত) আসামি ছিলেন।
সালমান এফ রহমান বর্তমানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন।
১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালের ৪ মে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে মামলা দুটি করা হয়। মামলা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরে উচ্চ আদালত মামলার বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করলে মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রমও থেমে যায়।
২০১৫ সালে পুঁজিবাজারবিষয়ক মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর মামলাগুলো বিচারিক কার্যক্রমের জন্য সেখানে স্থানান্তর হয়ে আসে। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম শুরুর আগেই মামলা দুটি বাতিল করে দেন উচ্চ আদালত।
জানা গেছে, মামলা দুটি বাতিল হওয়ার ফলে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি মামলা থেকে আসামিরা মুক্ত হয়ে গেছেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এ মামলা দুটি বাতিল করেছেন। আদালতের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘কোয়াশড’।
উচ্চ আদালতের আদেশের পর বিচারিক আদালতে মামলা দুটির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। মামলা দুটি বিচারের জন্য শেয়ার-বাজারবিষয়ক মামলা নিষ্পত্তিতে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তালিকাভুক্ত ছিল।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও মো. সেলিমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২০১৫ সালের ১৬ মার্চ মামলা দুটি বাতিলের আদেশ দেন। আর আদালতের সেই আদেশ বা রায়ের কপি বিচারিক আদালতে পৌঁছেছে প্রায় দুই বছর পর গত ১ জানুয়ারি। আদালতের ওই আদেশ পেয়ে শেয়ারবাজারবিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মামলা দুটির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
জানতে চাইলে হাইকোর্টে বেক্সিমকো গ্রুপের পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক গতকাল মঙ্গলবার বলেন, মামলা দুটি বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের লিখিত কপি চলতি মাসের শুরুতে বেরিয়েছে এবং তা বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের রায়ের পর ওই মামলা দুটির সব ধরনের কার্যক্রমও বাতিল হয়ে গেছে।
কোন আইনি ভিত্তিতে মামলা দুটি বাতিল হয়েছে জানতে চাইলে মঞ্জুরুল হক বলেন, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স-১৯৬৯-এর ১৭ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দুটি দায়ের করা হয়। কিন্তু আইনের ওই ধারার সঙ্গে মামলার অভিযোগ সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় আদালত দুটি মামলাই বাতিল করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে সালমান এফ রহমানের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর পক্ষে নিযুক্ত ইমপ্যাক্ট পিআরের মাধ্যমে তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য দেন। তাতে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘এত দিন ধরে আমি বলে আসছিলাম মামলাগুলোর কোনো ভিত্তি (মেরিট) ছিল না। অবশেষে আদালতে তা-ই প্রমাণ হয়েছে।’
’৯৬ সালের পর শেয়ারবাজারে আরেক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০১০ সালে। এ দুই কেলেঙ্কারির ঘটনায় মোট ১৭টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ’৯৬ সালের কেলেঙ্কারির জন্য ১৫টি এবং ২০১০ সালের জন্য করা হয় ২টি মামলা। এ ১৭ মামলার মধ্যে মাত্র একটি মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। ’৯৬ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় চিক টেক্সটাইলের মামলায় শেয়ারবাজার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালের আগস্টে অভিযুক্ত দুই আসামিকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়। কিন্তু আসামিরা দেশের বাইরে থাকায় সেই সাজা নিশ্চিত করা যায়নি। এ ছাড়া অন্য মামলাগুলোর মধ্যে সিংহভাগ মামলার বিচারিক কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ রয়েছে। আর ’৯৬ সালের কেলেঙ্কারির দুটি মামলা বাতিল হয়ে গেল। ফলে দুই দফায় ঘটা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির অভিযুক্ত ব্যক্তিরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাতিল হওয়া মামলা দুটি পুনরুজ্জীবিত করতে আপিলের সুযোগ রয়েছে। বাদীপক্ষকে এ আপিল করতে হবে। মামলা দুটিরই বাদী পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, মামলা দুটির বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য কমিশনের নিযুক্ত আইনজীবীকে এরই মধ্যে বলা হয়েছে। আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বেক্সিমকো ফার্মা, শাইনপুকুরসহ সালমান এফ রহমানদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা বাতিল ও বাজারে এর প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, কেন উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাগুলো বাতিল হয়ে গেল সেই বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। পাশাপাশি কোনো মামলা দায়েরের আগে যে আইন ও ধারায় অভিযোগ আনা হচ্ছে তা যথাযথ কি না, সেই বিষয়ে বিএসইসিকে আরও সচেতন হতে হবে। মামলায় আইনগত দুর্বলতা থাকলে তা আদালতে বাতিল হয়ে যেতে পারে। তাতে করে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা খালাস পেয়ে যাবেন।
’৯৬-এর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আমীরুল ইসলাম চৌধুরীর তদন্ত প্রতিবেদনে বেক্সিমকো ফার্মা সম্পর্কে বলা হয়, ’৯৬ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৬৭ টাকা। একই বছরের ১৬ নভেম্বর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬৮ টাকায়। আর নভেম্বরের শেষে এসে বাজারে পতন শুরু হয়। বেক্সিমকো ফার্মা ১৯৯৪ সালে একটি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে একটি অধিকারমূলক বা রাইট শেয়ার প্রস্তাব করে। অধিমূল্য বা প্রিমিয়ামসহ প্রতিটি রাইট শেয়ারের দাম ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা। তদন্ত কমিটির মতে, সে সময় রাইট শেয়ারের প্রিমিয়াম অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। যার সঙ্গে কিছু ব্রোকারস, কোম্পানিটির বড় অঙ্কের শেয়ারধারী এবং কোম্পানির কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।
শাইনপুকুর হোল্ডিংস সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ’৯৬ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ৭৩ টাকা। একই বছরের ২৮ নভেম্বর তা বেড়ে সর্বোচ্চ ৭৫৪ টাকায় ওঠে। ’৯৬ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে কোম্পানিটির প্রায় ৫২ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়। শাইনপুকুরের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিল বেক্সিমকো ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, সাতক্ষীরা ফিশারিজ, বাকখালী ফিশারিজ, মৃত্তিকা লিমিটেড এবং বেনামে বেক্সিমকো গ্রুপের কিছু কর্মকর্তা।