ঢাকা; রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভুত হত্যাকা-, অসংখ্য ধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া এমনকি পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য দায়ী মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। তারা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করেছে। এ বিষয়গুলোকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সেদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার এমনই বর্ণনা দিয়েছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিশদ সাক্ষাতকার, স্যাটেলাইটের বিভিন্ন ইমেজ ও ছবি, ভিডিও বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে আজ সোমবার অ্যামনেস্টি একটি নতুন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতেই এসব কথা বলা হয়েছে। এ রিপোর্টে কিভাবে সেনাবাহিনীর খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তার করেছে রোহিঙ্গাদের তা প্রামাণ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা গত দুই মাসের ওপরে কিভাবে রাখাইন রাজ্যে বৈষম্যমুলক কর্মকা- চালাচ্ছে। এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের পরিচালক রাফেন্ডি ডজামিন বলেছেন, রোহিঙ্গা বেসামরিক মানুষজনকে সহিংস অভিযানে নির্মম ও সিস্টেমেটিকভাবে টার্গেট করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা নারী, পুরুষ, শিশু এমনকি পুরো পরিবার ও অনেক গ্রামে হামলা চালিয়ে সেখানে নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছে রোহিঙ্গাদের। সেনাবাহিনীর এই বর্বর অভিযানকে বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে মারাত্মক ও সিস্টেমেটিক হামলা হিসেবে অভিহিত করা যায়। একই সঙ্গে এটাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনী যেভাবে আইন লঙ্ঘন করেছে তার যেটুকু আমরা জানতে পেরেছি তা মাত্র বরফের চাঁইয়ের সূচালো প্রান্ত মাত্র। এ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। রাফেন্দি ডজামিন বলেন, যখন আইন লঙ্ঘনের জন্য সরাসরি সেনাবাহিনী দায়ী তখন রাখাইন রাজ্যের চলমান এ ঘটনা বন্ধে বা এর নিন্দা জানাতে রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে ব্যর্থ হয়েছেন অং সান সুচি। অ্যামনেস্টি রাখাইনে হামলা ও হত্যাকা- সম্পর্কে বলেছে, গত ৯ই অক্টোবর সীমান্ত রক্ষাকারীদের প্রহরা চৌকিতে হামলা হয়। এর পর থেকে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক আকারে অভিযান শুরু করে। নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার জন্য মিয়ানমার দায়ী করে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের। কিন্তু সেনাবাহিনীর পাল্টা পদক্ষেপ কতটা ভয়াবহ সে সম্পর্কে উঠে এসেছে অ্যামনেস্টির গবেষণায়। ওই হামলার জবাবে পাল্টা যতটুকু ব্যবস্থা নিতে পারে নিরাপত্তা বাহিনী তাকেও অতিক্রম করে যাওয়া হয়েছে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা করেছেন কিভাবে সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে প্রবেশ করেছে, ঘরে আগুন দিয়েছে, নারী-পুরুষ-শিশুদের হত্যা করেছে। কমপক্ষে একটি ঘটনায় সেনা সদস্যরা এসব মানুষকে তাদের বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনেছে। তারপর তাদেরকে গুলি করে হত্যা করেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা জানাতে পারে নি অ্যামনেস্টি। সন্দেহজনক জঙ্গিদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর গত ১২ই নভেম্বর রাখাইনে কয়েকটি গ্রামের ওপর দুটি হেলিকপ্টার গানশিপ মোতায়েন করে সেনাবাহিনী। আতঙ্কে এ সময় যেসব গ্রামবাসী পালাতে চেষ্টা করেছেন তাদেরকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ওই হেলিকপ্টার থেকে। তবে এমন নিহতের সংখ্যাও জানা যায় নি। এর পরের দিন সেনারা কয়েক শত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ৩০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেছেন, যখনই হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পাই আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। একটানা গুলি করে যাচ্ছিল সেনারা। হেলিকপ্টার থেকে তারা কাউকে দেখলেই গুলি করে। দীর্ঘ সময় নিয়ে তারা এভাবে গুলি করতে থাকে। রাতের বেলা আমরা ঘুমাতে পারি না। এরও পরের দিন পদাতিক সেনারা আসে। তারা আবার গুলি করা শুরু করে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতারও অভিযোগ করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি বলেছে, নিরাপত্তা অভিযানের নাম করে মিয়ানমারের সেনারা নারী ও যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ করেছে। যৌন নির্যাতন করেছে। যখন ভয়ে গ্রামের পুরুষরা পালিয়ে ছিলেন তখনই তারা এই ন্যাক্কারজনক কাজ করেছে। এ বিষয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছে অ্যামনেস্টি। সাক্ষাতকারে ওইসব নারী বলেছেন, সেনারা তাদেরকে ধর্ষণ করেছে। এ ছাড়া যারা ধর্ষণ প্রত্যক্ষ করেছে তারাও তাদেরকে ধর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের সহায়তাকর্মীরা নিশ্চিত করেছেন, ধর্ষিত অনেক নারী বাংলাদেশে এসেছেন। তাদেরকে ক্ষতের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ৩২ বছর বয়সী ফাতিমা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী তার গ্রামে প্রবেশ করে। তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় পাশের ধানক্ষেতে। সেখানে তাকে ধর্ষণ করে সেনারা। একে একে তিন সেনা কর্মকর্তা তাকে ধর্ষণ করে। এরপর কি ঘটেছিল তিনি তা জানেন না। কারণ, তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফাতিমা বলেন, পরের দিন সকালে আমার চেতনা ফেরে। তখন আমি উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। তাই ধানক্ষেতের ভিতর দিয়েই হামাগুঁড়ি দিয়েছি। খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তারের বিষয়েও কথা বলেছে অ্যামনেস্টি। এতে বলা হয়, সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী শত শত রোহিঙ্গা পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছে। এমনকি তাদের টার্গেটে পড়েছেন গ্রামের বয়স্ক মানুষ, ব্যবসায়ী, কমিউনিটি নেতারাও। অ্যামনেস্টি তার রিপোর্টে কমপক্ষে এমন ২৩টি ঘটনা প্রামাণ্য হিসেবে তুলে ধরেছে। এসব রোহিঙ্গাকে তাদের পরিবারের কাছ থেকে জোর করে তুলে নিয়েছে পুলিশ। তারপর তারা কোথায় কি অবস্থায় আছেন তা আর জানা যায় নি। ওইসব রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও গঠন করা হয় নি। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মিডিয়া বলেছে, সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে নিরাপত্তা হেফাজতে কমপক্ষে ৬ জন মারা গেছেন। এর ফলে আটক অবস্থায় এসব মানুষের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আটক অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ওপর নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা মাঝেমধ্যেই প্রহার করে। এক নারীর দুই ছেলেকেই তুলে নিয়ে গেছে তারা। ওই নারী বলেছেন, আমার দুটি ছেলেকেই শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়। সেনারা তাদের দু’হাত পিছন দিকে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। তারপর তাদেরকে বেদম প্রহার করে। তাদের বুকে লাথি মারে সেনারা। এটা আমাকে নিজের চোখে দেখতে হয়েছে। তা দেখে আমি আর্ত চিৎকার করেছি।
(বিস্তারিত আসছে)
(বিস্তারিত আসছে)