রংপুর ডেস্কঃ প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর আসলেই বেগম রোকেয়া দিবস পালন করা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্তাদের মধ্যে। এক মাস আগে থেকে চলে জরাজীর্ণ স্মৃতিকেন্দ্রটি ধোয়ামোছা ও রং করার কাজ। অনুষ্ঠিত হয় সপ্তাহব্যাপী আলোচনা সভা সেমিনার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চলে বড় বড় বক্তৃতা দেওয়ার প্রতিযোগিতা।
রোকেয়ার স্মৃতিকে আরও জাগরুক করার জন্য দেওয়া হয় নানান প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবে এর কোনও প্রতিফলন দেখা যায় না। এমনকি ১২ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি। এটি চালু করার জন্য একাধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে গত আট মাসেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এদিকে, বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দে থাকা বাস্তুভিটাও এখন লুপ্তপ্রায়। বাড়ি ঘরের কোনও অস্তিত্ব নেই। দাঁড়িয়ে আছে কেবল দুটি ইটের সামান্য গাঁথুনি। দীর্ঘদিনেও সেখানে কোনও স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়নি। এভাবে অযত্নে অবহেলায় অচিরেই তার শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকুও বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তার স্মৃতিকে ধরে রাখা, সুবিধাবঞ্চিত নারীদের পুনর্বাসন এবং রোকেয়ার জীবন আর রচিত গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা করার জন্য ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি। ১৯৯৭ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ২০০১ সালে কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৪ সালে স্মৃতিকেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে তখন থেকে কেন্দ্রটির ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনও বেতন ভাতা পান না। তাই বাধ্য হয়েই পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
আরও জানা গেছে, বন্ধ হওয়ার পর থেকে অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে স্মৃতিকেন্দ্রটি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আশায় বুক বাঁধেন পায়রাবন্দের মানুষ। কিন্তু ৮ বছর পার হলেও কেন্দ্রটি চালু করার কোনও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।
এদিকে স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু করা, এর দায়িত্ব বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করা এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের বকেয়া বেতনভাতা পরিশোধ করতে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন স্মৃতিকেন্দ্রের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল ফারুখ। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১৭ মে অবিলম্বে স্মৃতিকেন্দ্রটি বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করে সব বকেয়া পরিশোধ করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ রায়ের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। অবশেষে চলতি বছরের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানি শেষে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন।
চলতি বছরের ২৩ মার্চ বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি পুনরায় চালু ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় রাখার জন্য একটি সার সংক্ষেপ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। যাতে ৭ এপ্রিল অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। তবে গত আট মাসেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল অভিযোগ করে বলেন, ‘মূলত আমলাদের দায়িত্বহীনতার কারণে স্মৃতিকেন্দ্রটি ধংস হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আসলে তারা চান না বেগম রোকেয়ার বাস্তুভিটাসহ স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু থাকুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব উদ্যোগেই স্মৃতিকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাই তিনিই পারেন এটাকে পুনরায় সচল করতে।’
রংপুর বেগম রোকেয়া ফোরামের সিনিয়র সহ-সভাপতি কথা সাহিত্যিক এম এ বাশার অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশাল স্মৃতিকেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় বেগম রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা বন্ধ রয়েছে। প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর আসলেই ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। বড় বড় বক্তৃতা দেন আমলা আর রাজনীতিবিদরা কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।’
পায়রাবন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফয়জার রহমান খান বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন না করায় আমরা হতাশ। তবে অল্প সময়ের মধ্যে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন না করা হলে এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন শুরু করা হবে।’