ঢাকা; বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মদিন আজ। তিনি ছিলেন বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত, লেখিকা ও শিক্ষাব্রতী। সারা দেশে যোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হবে। এ উপলক্ষে গতকাল প্রথমআলোর ঘরোয়া অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয় ঘোড়সওয়ারতথ্যচিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী
দেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে, ৯ ডিসেম্বর। আজ তাঁর স্মরণে দেশে পালিত হচ্ছে রোকেয়া দিবস। দিবসটির আগে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর আয়োজনে এক অনাড়ম্বর ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলো রোকেয়া স্মরণে। এতে ছিল নওগাঁর প্রত্যন্ত গ্রামের অদম্য এক বালিকা ঘোড়সওয়ারের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রের প্রথম প্রদর্শনী। আর ছিল রোকেয়ার জীবন, সংগ্রাম, রচনা ও দেশের নারী আন্দোলনে তাঁর অবদানের মূল্যায়ন করে আলোচনা।
কোনো মেয়ে ঘোড়ায় চেপে বাতাসে চুল উড়িয়ে পথ-ঘাট, প্রান্তর পেরিয়ে তিরের বেগে ছুটে যাচ্ছে—এমন দৃশ্য সিনেমায় সম্ভব হলেও বাংলাদেশে গ্রাম-শহরে প্রায় অকল্পনীয়। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ১১ বছরের তাসমিনা আক্তার। দেশের উত্তরাঞ্চল তো বটেই, গাজীপুর, ময়মনসিংহ এলাকায়ও ছিপছিপে গড়নের এই বালিকা এখন তুখোড় ঘোড়সওয়ার হিসেবেই সুখ্যাত। প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায় প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে ঘোড়ার পিঠে তার ছুটে চলার দৃশ্য।
নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার চকসুবল গ্রামের তাসমিনা আক্তার এবার পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা জেলায় শীতের মৌসুমে প্রায় নিয়মিতই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বছর তিনেক ধরে তাসমিনা এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। ইদানীং সে হারিয়ে দিচ্ছে তার পুরুষ ঘোড়সওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বীদের। ক্রমে উত্তরাঞ্চল ছাড়িয়ে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে। গাজীপুর, ময়মনসিংহেও সে ঘোড়দৌড়ে অংশ নিচ্ছে। তবে পুরস্কার জিতলেও সেটি তার ঘরে আসছে না। কারণ তাসমিনার নিজের ঘোড়া নেই। সে তার বাবা ওবায়দুল মণ্ডলের সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যায়। ঘোড়ার মালিকদের সঙ্গে তাদের রফা হয়। পুরস্কার জিতলে তা পাবেন ঘোড়ার মালিক। শেষাবধি তা-ই হয়। দৌড় শেষে তাসমিনার হাতে যে পুরস্কার ওঠে, মঞ্চ থেকে নেমে সেই পুরস্কার সে তুলে দেয় ঘোড়ার মালিকের হতে। তারপর বাবা-মেয়ে ধরে বাড়ির পথ। তবে তখন তার চোখেমুখে থাকে এক অন্যরকম আলোর দীপ্তি। সেই আলো ইচ্ছাপূরণের, অনাবিল আনন্দের। তসামিনার লাভ এই আনন্দটুকুই। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল তাসমিনা আক্তার ও তার বাবা ওবায়দুল মণ্ডল ও প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা তানহা জাফরীন।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আনিসুল হক তাঁর সূচনা ভাষ্যে বললেন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের রচনাবলিতে যেমন সুন্দর তাঁর ভাষার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি প্রকাশ আছে তাঁর চিন্তার বিস্তৃতির। সেই চিন্তা আধুনিক। তাতে আছে বিশ্ববীক্ষা। প্রধান আলোচক প্রাবন্ধিক অধ্যাপক মালেকা বেগম তাঁর আলোচনায় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে রোকেয়া রচনাবলি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করে বলেন, ‘ধর্ম-শ্রেণিনির্বিশেষে তিনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা সেই যুগে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সমাজ, রাষ্ট্রে এখনো নারীর প্রতি যে ধরনের বৈষম্য, নির্যাতন চলে, যেভাবে তাদের দমিয়ে রাখা হয়, তার সবই রোকেয়ার রচনায় স্থান পেয়েছে। নারীবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। আমাদের উচিত হবে গভীরভাবে তাঁর রচনা পাঠ করা।’
তাসমিনাকে নিয়ে ‘এক দুঃখী ঘোড়সওয়ারের গল্প’ নামে গত বছরের ১৭ জুন প্রথম আলোর অধুনা পাতায় রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাসমিনাকে একটি ঘোড়া কিনে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই অদম্য মনোবলের বালিকার স্বপ্নপূরণের কাহিনি বৃহত্তর জনপরিসরে তুলে ধরতে তাকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঘোরসওয়ারনামের এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছেন তানহা জাফরীন।
গতকালের অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন আলোকচিত্রী মুনিরা মোর্শেদ, তাসলিমা আখতার, আইনজীবী নাহিদ মাহতাব। তাসমিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁরা বলেন, সব বাধা অতিক্রম করে ওর এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে তাঁদের চোখ ভিজে গেছে।
প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা তানহা জাফরীন বলেন, এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে তাসমিনার দৃঢ় সংকল্প দেখে তিনি নিজেও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
তাসমিনা জানিয়েছে, সে পড়ালেখা চালিয়ে যাবে। স্কুলেও সে বেশ ভালো ছাত্রী। পঞ্চম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। তার ইচ্ছা পুলিশে চাকরি করা। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন। সম্পাদক মতিউর রহমান সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
ছবিটি আজ প্রথম আলো ডটকম, প্রথম আলো ফেসবুক পেজ, প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে একযোগে প্রদর্শিত হবে।
রোকেয়া দিবস আজ
নারী শিক্ষার বিস্তার, নারীকে রক্ষার আন্দোলন, নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, ভোটাধিকার আন্দোলনসহ নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু দিন (১৮৮০-১৯৩২) আজ। দিবসটিকে রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়। রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক প্রসিদ্ধ জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়া খাতুন, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মিসেস আর এস হোসেন নামেও লিখতেন এবং পরিচিত ছিলেন। রোকেয়া ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক প্রথাসহ বিভিন্ন বিষয়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দেশের নারী উন্নয়নে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে সহযাত্রী হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত, বিচারপতি, সচিব, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বিভিন্ন পদে নারীরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। নারীদের এই উন্নতি রোকেয়ার স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়নেরই সফল ধারাবাহিকতা।
রোকেয়া দিবস উপলক্ষে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আজ সকাল ১০টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিত থাকার কথা। তিনি রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত দুজনের হাতে সম্মাননা তুলে দেবেন।