বিবেকের মৃত্যু

Slider টপ নিউজ

43466_f2

 

ঢাকা; তিনি ছিলেন বিবেকের বন্দি। তার দীর্ঘ গৃহবন্দিত্ব পুড়িয়েছে সারা দুনিয়ার মানুষের মন। কেউ প্রার্থনা করেছেন, কেউ করেছেন প্রতিবাদ। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সব সময়ই সরব ছিল আন্তর্জাতিক দুনিয়া। মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের জন্য অং সান সূচির লড়াই স্বীকৃতি দেয় নোবেল কমিটিও। তাকে দেয়া হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার।
হায়, কেমন ছিল সেই দিনগুলো। এত দ্রুতই অং সান সূচি ভুলে গেলেন সব। ক্ষমতা মানুষকে এতটা বদলে দেয়। বিশ্বাস হয় না। তবুও এটাই সত্য। যদিও সূচির এই পরিবর্তনের ধারা বুঝা যাচ্ছিল আগে থেকেই। ক্ষমতার রাজনীতি তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন। যে কারণে নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতনের ইস্যুতে তিনি ছিলেন নীরব। তবুও অনেকে তার পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছিলেন, এটা বুঝি তার এক ধরনের কৌশল। একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে নিশ্চয়ই তিনি মানবাধিকারের মতো ইস্যুতে নীরব থাকবেন না। আর যাই হোক, তিনি তো মানবাধিকারের নেত্রী। সে আশা অবশ্য মানুষের পূরণ হয়নি। যদিও চাপের মুখে অনেকটা বাধ্য হয়েই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন তিনি গঠন করেছেন। যার নেতৃত্বে রয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। কিন্তু বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সূচির মানসিকতা ফুটে ওঠে অনেকটাই। একজন মুসলিম সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নেয়ায় তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
তবে সূচি তার মানবিকতার সব কিছুই যেন বিসর্জন দিলেন এবার। তিনি যখন ক্ষমতায় তখন রাখাইন রাজ্যে রীতিমতো চলছে রোহিঙ্গা নিধন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অথবা মানবাধিকার সংগঠন কাউকেই মিয়ানমার সরকার সেখানে যেতে দিচ্ছে না। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এক সুরে বলছে, সেখানে গণহত্যা চলছে। চলছে ধর্ষণ, নির্যাতন। এমনকি খোঁদ জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও প্রায় একই কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, সেখানে সম্ভবত গণহত্যা চলছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গা এ দফায় বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে এ বিশ্ব সংস্থাটি। না এই পরিস্থিতিতে নীরব থাকেননি শান্তির নোবেল কন্যা অং সান সূচি। তিনি মুখ খুলেছেন। আর সাফাই গেয়েছেন নির্যাতনের। দোষারোপ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। হ্যা, ঠিকই পড়ছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই সূচি দোষারোপ করছেন। কী আশ্চর্য! এ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় না থাকলে তিনি কোনোদিন মুক্তি পেতেন। মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারতেন। কী আশ্চর্য প্রতিদান। চলতি সপ্তায় বিস্ময়কর ওই টিভি সাক্ষাৎকারে সূচি কী বলেছেন তা একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যায়। তার ভাষ্য, রাখাইনে  বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ উসকে দিচ্ছে বিশ্ব সম্প্রদায়। তার দাবি, বিশ্ব নেতারা রাখাইন পরিস্থিতির নেতিবাচক দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
অং সান সূচির এই বিস্ময়কর পতনের জন্য এরই মধ্যে দেশে দেশে দাবি উঠেছে, তার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহার করা হোক। লাখ লাখ মানুষ এরই মধ্যে ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। ইতিহাসে নোবেল প্রত্যাখ্যানের ঘটনা আছে, কিন্তু নোবেল প্রত্যাহারের ঘটনা নেই। সূচির ক্ষেত্রেও হয়তো তা ঘটবে না। কিন্তু মৃত বিবেক সূচির ঘরে শান্তির নোবেল যে স্বয়ং পুরস্কারটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে তা হয়তো না বললেই চলে। যদিও নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলে আসছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে নিপীড়ন চলছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি খুব কমই কাড়তে পেরেছে। এ কথা সত্য, কেউ যদি অপরাধ করে তার বিচার হতে হবে। কিন্তু একটি জাতি-গোষ্ঠীর গুটি কয়েক লোকের অপরাধের জন্য একটি পুরো জাতিকে ধ্বংস বা নিধন করা দুনিয়ার কোনো আইনেই অনুমোদনযোগ্য নয়। অথচ ঠুনকো অজুহাতে চলা রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে কোনো কার্যকর উদ্যোগই নিচ্ছে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। কেউ কেউ শুধু লিপ সার্ভিসেই কাজ সারছেন। জাতিসংঘ এ নিয়ে সরব হলেও তা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি এখনও। এমনকি ওআইসিও বিসম্ময়করভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। যদিও মালয়েশিয়া এ নিয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। সমাবেশে যোগ দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। বলেছেন, রোহিঙ্গা গণহত্যা বিশ্ব বসে বসে দেখতে পারে না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, বিশ্ব তা বসে বসেই দেখছে।
রাখাইনে মৃত্যুর মিছিল চলছে। মারা যাচ্ছে মানুষ। ধর্ষিত হচ্ছে মানুষ। পুড়ছে ঘরবাড়ি। এই অবস্থায়, আসুন আমরা সবাই মৃত বিবেকের জন্য প্রার্থনা করি। জেগে উঠুক মৃত বিবেক। জেগে উঠুক বিশ্ব সম্প্রদায়। প্রার্থনা ছাড়া আমাদের আর কী-ই বা করার আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *