এস. এম. মনিরুজ্জামান মিলন, রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধিঃ আজ ৩ ডিসেম্বর, ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস। ৭১’র এই দিন পাকহানাদার মুক্ত হয় এ জেলা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকসেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালিদের উপর। তাদের প্রতিরোধ করতে সারাদেশের মত ঠাকুরগাঁওবাসীও গড়ে তুলেছিল দুর্বার আন্দোলন।
৭১’র ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর ঠাকুরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আলহাজ্জ্ব ফজলুল করিমকে আহবায়ক করে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ২৭ মার্চ পাকবাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ হয় রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী। পরদিন ২৮ মার্চ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করায় শিশু নরেশ চৌহানকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। ২৯ মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআর এর সুবেদার কাজিমউদ্দিন সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে হাবিলদার বদিউজ্জামানের সহায়তায় অস্ত্রাগারে হামলা চালায়। তারা সমস্ত অস্ত্র বাঙ্গালি সেনাদের হাতে তুলে দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তার নির্দেশে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ফলে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার পুরোপুরি বাঙ্গালিদের দখলে চলে আসে। তখন থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রশাসন পরিচালিত হতে শুরু করে আলহাজ্জ্ব ফজলুল করিমের নির্দেশে। এ সময় ১০টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীকে ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকতে না দেয়ার জন্য ২০টি জায়গা নির্ধারণ করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ১০ এপ্রিল থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের সঙ্গে অন্যান্য মহকুমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
প্রায় ৮ মাস যুদ্ধের পর ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর ঠাকুরগাঁওয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে পাকবাহিনী। ৩০ নভেম্বর পাকসেনারা ঠাকুরগাঁওয়ের ভুল্লী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। ১লা ডিসেম্বর কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করে। ২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হয় পাকবাহিনী। ৩ ডিসেম্বর বিজয়ীর বেশে ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করে মুুক্তিযোদ্ধারা। স্বদেশের পতাকা উড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আনন্দ উল্লাস করে ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিকামী মানুষ। বিজয় ছিনিয়ে আনতে ৩০ হাজার নারী পুরুষকে প্রাণ দিতে হয়। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন ২ হাজার মা-বোন।
দিবসটি উপলক্ষে বেলা ১১ টায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ঠাকুরগাঁও জেলা ইউনিট কমান্ড ও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ঠাকুরগাঁও জেলা সংসদের যৌথ আয়োজনে ঠাকুরগাঁও সাধারণ পাঠাগার চত্বরে জাতীয় সংগীতের তালে তালে জাতীয় ও সাংগঠনিক পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধা নামফলক, জেলার প্রথম শহীদ মোহাম্মদ আলীর সমাধী ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে নির্মিত ‘অপরাজেয় ৭১’ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ অর্পন করা হয়।
কর্মসূচির উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক পৌর মেয়র আকবর হোসেন। এছাড়াও উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আওয়াল, জেলা পুলিশ সুপার ফারহাত আহমেদ, প্রেসক্লাব সভাপতি আবু তোরাব মানিকসহ আরও অনেকে।
পরে শহরে মুক্তির শোভাযাত্রা বের হয়। শোভাযাত্রায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, নিরাপদ সড়ক চাই, ঠাকুরগাঁও মহিলা পরিষদ, শিশু একাডেমী, ঠাকুরগাঁও পলিটেকনিক এন্ড টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, আর কে স্টেট স্কুলসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা অংশ নেন।
শোভাযাত্রাটি ঠাকুরগাঁও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তির শোভাযাত্রা র্যালি কমিটির আহবায়ক আবু মো. মহীউদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধারা তরুণ সমাজের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুলে ধরেন।