বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হলো যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন তাঁরা মনে করেন, তাঁদেরই ক্ষমতায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ ষড়যন্ত্র করে তাঁদের সেখানে ঠেলে দিয়েছে। আর ক্ষমতাসীনদের বদ্ধমূল ধারণা, বিরোধী দল তাঁদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করছে, তা কঠোর হাতে দমন করতে না পারলে দেশ ও জাতির সর্বনাশ হয়ে যাবে। দুই পক্ষের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মাঝখানে পড়ে দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার যে বারোটা বেজে গেল, সেসব নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আজ আওয়ামী লীগের নেতারা যা বলছেন, ক্ষমতায় থাকলে বিএনপির নেতারাও তা–ই বলতেন। আর বিএনপির নেতারা যা বলছেন, বিরোধী দলে থাকলে আওয়ামী লীগ নেতারাও ভিন্ন কিছু বলতেন না।
গণতন্ত্র মানলে তার অপরিহার্য উপাদান নির্বাচনও মানতে হবে। আর সেই নির্বাচন পরিচালনা করতে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি হলো খুব কম নির্বাচন কমিশনই বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পেরেছে। দুই কমিশনের প্রধান (এম এ আজিজ ও এম এ সাদেক) তো নির্বাচন না করে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছিলেন। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন কতটা খারাপ করেছে, সেই বিশ্লেষণের চেয়েও যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, আগামী ফেব্রুয়ারিতে এর মেয়াদ শেষ এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। কীভাবে? সংবিধানে আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও গত ৪৫ বছরে সেই আইন কেউ করেননি।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা চলে আসছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে উত্থাপিত সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে আগের বারের মতো অর্থাৎ সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন করার কথা বলা হয়েছে। আইনমন্ত্রীও সে রকম ইঙ্গিত দিয়েছেন। অন্যদিকে গত ১৯ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন গঠন–প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আলোচনার ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা উচিত। তাঁর প্রস্তাবগুলো আলোচনার ভিত্তি হতে পারে। সরকারের কাছে এর চেয়ে উত্তম প্রস্তাব থাকলে সেটি নিয়েও কথাবার্তা হতে পারে।
কিন্তু খালেদা জিয়ার প্রস্তাব পেশের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে মনে হবে বিএনপির চেয়ারপারসন মহা অন্যায় করে ফেলেছেন। আমরা এত দিন দেখে এসেছি, সরকার বা সরকারি দল কোনো আলোচনার প্রস্তাব দিলে বিরোধী দল নাকচ করে বা নানা শর্ত জুড়ে দেয়। এখানে সরকারি দলই বিএনপির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। এত দিন তারা বলে আসছিল, জামায়াতকে ছাড়লে আলোচনা হতে পারে। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে জামায়াতকে ছাড়া ও ধরা—দুই দিকের কথাই আছে। তিনি বলেছেন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বা সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। নিবন্ধিত বললে, জামায়াত বাদ পড়ে। আর সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দল এলে জামায়াত যুক্ত হয়। কিন্তু সরকারি দল আলোচনা করতেই রাজি নয়। একজন মন্ত্রী তাঁর প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এটি খুবই বিপজ্জনক। আরেক মন্ত্রী বলেছেন, খালেদার প্রস্তাবে নতুন কিছু নেই। নতুন কিছুই যদি না থাকবে, তাহলে বিপজ্জনক হলো কীভাবে?
বিশ্লেষকদের মতে, নিকট অতীতে বিএনপি কিছু ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করার কারণে দলের নেতারা যতই নমনীয়তা দেখাচ্ছেন, সরকার ততই কঠোর হচ্ছে। আইন প্রতিপালন কিংবা অপরাধের বিচারে সরকার কঠোর হোক, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতির যে অপরিহার্য অনুষঙ্গ আলোচনা-সমঝোতা, সেসব ক্ষমতাসীনেরা অগ্রাহ্য করতে পারেন না। বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের প্রধান অভিযোগ, তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে (যদিও বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধী নয়) এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল। যদি যুক্তির খাতিরে ধরেও নিই যে বিএনপি সেই চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু শেষ বিচারে তো তারা সফল হয়নি। একতরফা হলেও যে নির্বাচন হলো তার জোরেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। বিএনপি নির্বাচনের বিরোধিতা করেছে, বলে দলের নেতা-কর্মীদের যথেষ্ট কাফফারা দিতে হয়েছে। কিন্তু একতরফা নির্বাচনের কোনো ক্ষতিপূরণ আওয়ামী লীগকে দিতে হয়নি। বরং বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে সরকার দৌড়ের ওপর রেখেছে।
কিন্তু এত সব কাণ্ড করে কি ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিরোধী দলকে দৌড়ের ওপর রাখলে তা থেকে সরকার কোনো রাজনৈতিক সুবিধা পায় না; বরং বিরোধী দলের প্রতি জনগণের সহানুভূতি বাড়ে। মানুষ বিএনপির শাসনামলের অবিচারের সঙ্গে বর্তমানকে মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করবে। নিকট অতীতে ক্ষমতাসীন বিএনপি এবং তারও আগে এরশাদ ও জিয়ার শাসনামলের চালচিত্রটা ক্ষমতাসীনেরা একবার স্মরণ করতে পারেন। ২০০১-০৬ সালে বিএনপি সরকারের বাড়াবাড়ির ফল তারা পেয়েছে। সে সময় বিএনপির সঙ্গী ছিল জামায়াত, আর এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গী হলো স্বৈরাচারী এরশাদ। জিয়া যদি যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়ে পাপ করে থাকেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক-রশীদকে দেশে এনে রাজনীতির মাঠে নামিয়ে এরশাদ মহাপাপ করেছেন। আওয়ামী লীগ পাপীকে ধরলেও মহাপাপীকে ছাড় দিচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকার আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে যে অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে, অতীতের কোনো সরকার তা পায়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে হাত দিলেন, তখনই তাঁর বিরুদ্ধে অতি বামেরা সশস্ত্র তৎপরতা চালালেন এই বলে যে দেশটি স্বাধীনই হয়নি। আবার সরকারের বিরোধিতার নামে কেউ পাটের গুদামে আগুন দেওয়া এবং ঈদের জামায়াতে মানুষ মারার কাজও শুরু করলেন (তখন কিন্তু বিএনপি–জামায়াতের জন্মই হয়নি)। পরবর্তীকালে জিয়া, এরশাদ, খালেদা এমনকি ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকারও শক্ত বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। সেই তুলনায় এখন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সরকারের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জই নেই। সংসদের ভেতরে অনুগত বিরোধী দল আর বাইরে দৌড় খাওয়া বিএনপি। বিএনপি যখন জ্বালাও পোড়াও হরতাল-অবরোধ থেকে বেরিয়ে এসে অনেকটা ‘মুচলেকা’ দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল রাজনীতিতে ফিরে আসতে চাইছে, তখন কেন সরকার তাদের ফের ধ্বংসাত্মক পথে নিয়ে যেতে চাইছে?
খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের দুটি দিক আছে। একটি নির্বাচন কমিশন গঠন–সংক্রান্ত। আরেকটি নির্বাচন প্রক্রিয়াগত। দ্বিতীয়টির বিষয়ে কথা থাকতে পারে। কিন্তু প্রথমটি অর্থাৎ সব দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনে ওজর তোলার কী কারণ থাকতে পারে?
বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি যত নরম হচ্ছে, সরকার ততই গরম হচ্ছে। এটি দেশের গণতন্ত্র তো নয়ই, ক্ষমতাসীনদের জন্যও কোনো শুভ বার্তা বয়ে আনবে না। দেশের মানুষ রাজনীতির কাছ থেকে বেশি কিছু চায় না। তারা পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের একটি সুস্থ ও সুষ্ঠু পরিবেশ চায়। তারা রাজনীতিকদের কাছে একটু সহমর্মিতা ও সহনশীলতা আশা করে। কিন্তু মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতারা তার বিপরীতে হাঁটাকেই ভোট পাওয়ার গ্যারান্টি হিসেবে ধরে নিয়েছেন। অনুগ্রহ করে তাঁদের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে বলব। ১৯৭০ সালে আইন, শাসক, সেনাবাহিনী—সবকিছু তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছিল। এমনকি পাকিস্তানি শাসক চক্র বাঙালিদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে নানা অপকৌশল নিয়েছিল। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ইয়াহিয়া খানের এলএফও বা লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। তিনি জবাবে বলেছিলেন, জনগণের রায় পেলে কোনো ফ্রেম ওয়ার্কই কাজে আসবে না এবং সেটি তিনি প্রমাণও করেছিলেন। স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে গণমাধ্যম, প্রশাসন, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগই জয়ী হবে। কিন্তু জনগণ বিএনপির পক্ষেই রায় দিয়েছিল এবং খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেছিলেন। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে বিরোধীদের প্রচারণা ছিল যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই অপপ্রচারে কান দেয়নি, তারা আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছে, তার পেছনে নিজ নিজ দলের কৃতিত্ব তেমন ছিল না। ক্ষমতাসীনদের বাড়াবাড়ির জবাবই জনগণ ভোটের মাধ্যমে দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ যদি দেশের এতই উন্নতি করে থাকে, তাহলে আগামী নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে এত বিচলিত কেন? সব দলের মতামতের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারলে সেটা দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তখন আওয়ামী লীগ জনগণকে বোঝাতে পারবে যে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় থাকতে সমঝোতা না চাইলেও তারা সমঝোতায় বিশ্বাসী এবং জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
বাংলা ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘নিজের ভালো নাকি পাগলেও বোঝে’। কিন্তু গত পঁয়তাল্লিশ বছরে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা সেটি বুঝতে পারেননি, ভবিষ্যতে পারবেন িক?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।