ঢাকা; সময় ১১ মাস। এই সময়ে বদলি হয়েছেন ৬৪৬ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে একজন কর্মকর্তাকে একাধিকবার বদলির রেকর্ডও রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বদলি আতঙ্কে ভুগছেন ১ হাজার উপ-সহকারী প্রকৌশলী। চিত্রটা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গণপূর্ত অধিদপ্তরের। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ জনকে বদলি করা হয়েছে এখানে। এতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এক অর্থবছরে বাংলাদেশের কোনো সরকারি অফিসে এত বদলির ঘটনা ঘটেনি। রাজনৈতিক ও আর্থিক এই দুই কারণে বদলির সংখ্যাটা ক্রমে বাড়ছে। কয়েকজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মানবজমিনকে জানান, সকাল হলে দুরু দুরু বুকে অফিসে যাই। আবার একই টেনশন নিয়ে প্রতিদিন অফিস শেষ করি। কখন বদলির চিঠিটা হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে জানি না। বদলি মানেই ব্যাগ-ব্যাগেজ গোছানো। সন্তানদের স্কুল-কলেজ নিয়েও চলে টানাপড়েন। স্ত্রী ঢাকায় চাকরিজীবী হলে সমস্যা আরো প্রকট। সবমিলিয়ে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হচ্ছে এসব প্রকৌশলীকে। উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতাউর রহমান ছিলেন নগর গণপূর্তে। তাকে বদলি করা হয় মৌলভীবাজারে। কয়েক মাস যেতে না যেতেই আবার পাঠানো হয় বান্দরবানে। এক বছরে তাকে তিনবার বদলি করা হয়েছে। প্রকৌশলী মাসুদুল হাসানকে প্রথমে ঢাকা থেকে পাঠানো হয় ঠাকুরগাঁওয়ে পরে আবার তাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। একইভাবে প্রকৌশলী আহমদ উল্লাহকে প্রথমে ঢাকা জরিপ গণপূর্ত থেকে পটুয়াখালী পরে আবার তাকে পাঠানো হয় লক্ষ্মীপুরে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বদলির এ রেকর্ডের নেপথ্যে দুটি কারণ রয়েছে বলে জানান তারা। এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক অন্যটি আর্থিক। গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রকৌশলীদের দুটি সংগঠন রয়েছে। একটি বাংলাদেশ পিডব্লিউডি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি। এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। তারা সবাই উপ-সহকারী প্রকৌশলী। অন্যটি বিসিএস পাবলিক ওয়ার্কস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন। সহকারী থেকে প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত প্রায় ৬শ’ জন এর সদস্য। এ সংগঠনের তেমন কাউকে বদলি করা না হলেও সব বদলি করা হয়েছে উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের। যারা পিডব্লিউডি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জন উপ-সহকারী প্রকৌশলী জানান, প্রতিটি বদলির জন্য রয়েছে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন। এটাও আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত। ঢাকায় যেসব এলাকায় নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ বেশি সেসব এলাকায় বদলির জন্য নেয়া হয় ১৫ লাখ টাকা। মাঝারি কাজের জায়গার জন্য ১০ লাখ টাকা। আর ঢাকায় থাকার জন্য নেয়া হয় ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা। তারা জানান, রমনা, ধানমন্ডি, শেরেবাংলা নগর ও গুলশান এলাকার গণপূর্ত অফিসে বদলির জন্য নেয়া হয় সর্বাধিক ১৫ লাখ টাকা। গণপূর্তের একটি সিন্ডিকেট এ বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ প্রকৌশলীদের। তারা জানান, বদলির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বাণিজ্য। একজনকে শাস্তিস্বরূপ ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। আর্থিক লেনদেনে তুষ্ট হলে তাকে আবার নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। আবার কেউ টাকা দিতে রাজি না হলে তাকে বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাঠানো হয়। এখানে মানবিক দিক বিবেচনার বিষয়টি একেবারে উপেক্ষিত থাকে। বদলি সিন্ডিকেটের সঙ্গে কারা জড়িত এমন প্রশ্নে বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, মূলত বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান মুন্সী ২০১৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বদলির ঘটনাগুলো ঘটেছে। তার পক্ষে বদলির বিষয়টি দেখাশোনা করেন ঢাকা গণপূর্তের ইএম জোনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবদুল কুদ্দুসসহ আরো কয়েকজন। এ প্রসঙ্গে হাফিজুর রহমান মুন্সী মানবজমিনকে বলন, বদলির এ সংখ্যাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। সংখ্যাটি হয়তো চারশ’ হতে পারে। তিনি একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপনীয় প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, এখানেও বদলির সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৩শ’র মতো। এত বদলির প্রয়োজন কেন হলো প্রশ্নে তিনি বলেন, অফিসিয়াল কারণে এসব বদলি করা হয়েছে। এ নিয়ে কোনো বাণিজ্যের ঘটনা ঘটেনি। চলতি ডিসেম্বর মাসে হাফিজুর রহমান মুন্সীর চাকরির বর্ধিত মেয়াদ (মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি এক বছর) শেষ হচ্ছে। যদিও তার বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি জামুকাতে তদন্তাধীন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এদিকে একই প্রসঙ্গে উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধ দলের সদস্যরা এ অভিযোগ করতে পারেন। তবে তা সঠিক নয়। বিরুদ্ধ দলের সদস্য কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার। এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে পারবো না। সম্প্রতি সংসদ সচিবালয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের বদলির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে কমিটির সদস্যরা বদলির সংখ্যা জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেন।