চার্লি চ্যাপলিনের জীবনও। চ্যাপলিনের প্রথম তিনটি বিয়ে টেকেনি। ভেঙে গেছে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই। অনেক সমালোচকই বলেন, চ্যাপলিনের এই বিয়ে ও সম্পর্কগুলোর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার বিষয় ছিল খুবই কম। চ্যাপলিনের খ্যাতি আর অর্থবিত্তের প্রতিই তাঁদের টান ছিল বেশি। ৫৪ বছর বয়সে চ্যাপলিনের সঙ্গে যখন তাঁর চতুর্থ স্ত্রী বিশ্বখ্যাত নাট্যকার ইউজিন ও’নীলের কন্যা ওনা ও’নীলের পরিচয় হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। ৩৭ বছর বয়সের ব্যবধান নিয়েই বিয়ে করেন দুজন। ৮৮ বছর বয়সে চ্যাপলিন যখন মারা যান, তখন চ্যাপলিনকে ঘিরে রেখেছিলেন এই ওনা, তাঁদের আট সন্তান ও নাতি-নাতনিরা। এই অসম সম্পর্কের একটি জবাব ছিল মেয়েটির কাছে। তিনি বলতেন, ‘আমি চ্যাপলিনকে তরুণ করেছি আর চ্যাপলিন আমাকে করেছে পরিপক্ব। এভাবেই আমরা দুজন দুজনের কাছাকাছি এসেছি।’
সব ক্ষেত্রে এই চ্যাপলিন-ওনা তত্ত্ব কাজে দেবে, তা নিশ্চয়ই নয়। তবে এটা হয়তো আমরা মানতেই পারি যে সম্পর্ক হওয়া বা তা টিকে যাওয়ার সঙ্গে ভালোবাসার প্রশ্নটাই আসল। আর সম্পর্ক টিকে থাকা না-থাকার রসায়নে বয়সের ফারাক সব ক্ষেত্রে ভূমিকা না-ও রাখতে পারে। কিন্তু বয়সের পার্থক্যের অসম সম্পর্ক ও বিয়ে দুনিয়াজুড়ে এখনো আলোচনা-সমালোচনা, গবেষণা ও জরিপের এক জনপ্রিয় বিষয়। এ ধরনের সম্পর্কের ভালো-মন্দ বা বিপদের দিক নিয়েও আছে মত-ভিন্নমত।
সম্পর্কের জটিলতা সব ক্ষেত্রেই রয়েছে, ‘অসম’ সম্পর্কের জটিলতার কিছু বিশেষ দিক বিভিন্ন গবেষণায় সাধারণভাবে চিহ্নিত। এগুলো অনেকটা এ রকম: কর্তৃত্বের সমস্যা, বিশেষ করে যার বয়স বেশি, তার কর্তৃত্ব করার প্রবণতা, প্রজন্মের ব্যবধানের কারণে অনেক কিছু বোঝা না-বোঝা এবং ধারণ করা না-করার সমস্যা, দুজনের মধ্যে যিনি বয়সে বেশি বড়, তাঁর একটি জোরালো ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠা এবং নিজেকে পরিবর্তন করতে না চাওয়া বা শারীরিক-মানসিক সামর্থ্য ও চাওয়ার পার্থক্য। সমস্যাগুলো জানা থাকলে তা সামাল দেওয়া সহজ। ফলে ‘অসম’ সম্পর্কের মধ্যে যাঁরা আছেন, এসব মাথায় রেখে পথ চললে যাত্রাভঙ্গের আশঙ্কা কমলেও কমতে পারে।
বয়সের বেশি ব্যবধান বা অসম সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছেলেদের বয়স বেশি হবে, মেয়েদের কম—এই রকমটাই শুধু ঘটে না। নেপোলিয়ানের স্ত্রী জোসেফিন তার চেয়ে ৬ বছরের বড় ছিলেন। এমন ঘটনা অনেকই ঘটে, তবে হলিউডের খবরগুলো আমরা বেশি পাই। ডেমি মুর ৪২ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন ২৭ বছর বয়সী অ্যাশটন কুচারকে। ৫ বছর টিকেওছিল সে বিয়ে। ম্যাডোনার বয়স যখন ৫১, তার প্রেমিক জেসাস লুজ ছিলেন ২৩।
আমাদের দেশে অনেক ছেলেকেই জানি ও দেখি, যারা তাদের চেয়ে বেশি বয়সী মেয়েদের প্রেমে পড়ে বা আকৃষ্ট হয়। সম্পর্ক তো আর একতরফা হয় না, বেশি বয়সী মেয়েটির সাড়া বা প্রত্যাখ্যানের ওপরই নির্ভর করে অসম সম্পর্কটি গড়ে ওঠা বা না-ওঠা। এটা ছেলেদের একটা বিশেষ ধরনের পছন্দ। বলা ভালো, একটা নির্দিষ্ট বয়সেই এই প্রবণতা বেশি জোরালো থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের ক্ষেত্রে আবার তা কেটেও যায়। ব্যতিক্রমগুলোই অসম সম্পর্ক হিসেবে রয়ে যায়, টিকে থাকে।
আবার এমন অনেক মেয়েকে দেখেছি ও জানি, যারা আকৃষ্ট হয় তাদের চেয়ে বেশি বয়সী ছেলেদের প্রতি। একটি মেয়ে হয়তো কোনো সুযোগে তার চেয়ে বেশ বেশি বয়সী ছেলের সংস্পর্শে এসেছে, ছেলেটি তার বয়স ও অভিজ্ঞতার কারণেই নানা ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। অথবা ছেলেটি হয়তো মেয়েটিকে মুগ্ধ করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই নিজেকে সেভাবে তুলে ধরে। বেশি বয়সী ছেলেদের অভিজ্ঞতা, বাস্তব জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতি একটি মেয়ের এই মুগ্ধতার সরাসরি ফল হচ্ছে, সমসাময়িক ছেলেদের তখন আর খুব ‘ম্যাচিউরড’ মনে হয় না। এই চক্রে যে মেয়ে একবার পড়ে, তাদের জন্য বের হওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যতিক্রমও আছে, রানু অধিকারী ঠিকই বের হয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ-মুগ্ধতা থেকে।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের আমার বিষণ্ন বেশ্যাদের স্মৃতি উপন্যাসে দেখি, থুড়থুড়ে বুড়ো খুঁজছেন অনাঘ্রাতা কুমারীকে, আর কলেরার দিনগুলিতে প্রেম উপন্যাসে দুই নারী-পুরুষ প্রথম জীবনে প্রেমে পড়ে আলাদা আলাদা বিয়ে করে দাদা-দাদি হয়ে যাওয়ার পর নিজেরা আবারও বিয়ে করে জীবনসায়াহ্নে এসে। আসলে সম্পর্ক এমনই জিনিস, এটা শুধু বয়সের বেশি পার্থক্য বা মেয়েটি ছেলেটির চেয়ে বড় এসব ‘অসম’ দোহাইয়ের কারণে আটকে থাকে না, দুই বুড়োবুড়িও প্রেম করতে পারে, আর পারে শেষ বয়সে এসে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে।
সম্পর্ক তো হতেই পারে, কিন্তু এ ধরনের ‘অসম’ সম্পর্ক টিকে থাকে কি না সেটা এক জরুরি বিবেচনা বটে। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা একটি জরিপ এ বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। জরিপের ফল হচ্ছে, বয়সের ব্যবধান যত, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার হারও তত বেশি। এই জরিপ বলছে, বয়সের ব্যবধান ৫ হলে বিচ্ছেদের হার ১৮ শতাংশ, ১০ বছর হলে ৩৯ আর ২০ বছর হলে এই হার ৯৫ শতাংশ! যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের ওপর চালানো এই জরিপ আমাদের দেশের জন্য খুব বাস্তব না-ও হতে পারে। আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি বা এর আগের প্রজন্ম তো অসম বিয়ে আর সম্পর্কের মধ্য দিয়েই জীবন পার করে গেছেন!
আবার অস্ট্রেলিয়ার পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, বেশি বয়সের মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের সম্পর্কের হার দিন দিন বাড়ছে। ৫৫ ভাগ নারী স্বীকার করেছেন, তাঁরা জীবনের কোনো না কোনো সময় কম বয়সী পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছেন। ভ্যালেরি গিবসন নামের একজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটা পৃথিবীতে চিরকাল ছিল, বাস্তব কারণে আগে তা প্রকাশিত হতো না, বা পরিণতি পেত না, এখন পাচ্ছে। তবে এই ধরনের সম্পর্ক সাধারণত টেকে না, কিন্তু তার কারণ হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ বয়সের পার্থক্যকে দায়ী করছেন না, দায়ী করছেন অন্য বিয়েগুলো যেসব কারণে ভাঙে, সেসব কারণকেই।
একটি বহু চলতি কথা দিয়ে শেষ করি, প্রেম ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে বয়স, দূরত্ব, উচ্চতা বা ওজন—এসব নাকি শুধুই ‘সংখ্যা’। ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জরিপের কথা উল্লেখ করলাম, সেটাও সংখ্যারই হিসাব। প্রেম-ভালোবাসা বা সম্পর্কের চেয়ে নিছক সংখ্যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কীভাবে! সব ছাপিয়ে যুগে যুগে প্রেম-ভালোবাসাই তো এগিয়ে থেকেছে। সম বা অসম এখানে খুব পাত্তা পায় না।