দলীয় প্রভাবমুক্ত ইসি দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

Slider জাতীয়

42453_burnicat

 

ঢাকা; সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনে দলনিরপেক্ষ, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন মুখ্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট। গতকাল বিকালে কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতি-ডিকাব আয়োজিত মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন। সেখানে মার্কিন দূত আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে তার দেশটির আগ্রহের বিষয়টিও স্পষ্ট করেন। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনবিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমাদের প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন কমিশনটি স্বাধীন, শক্তিশালী ও দল নিরপেক্ষ হবে; যা একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ-বৈঠকের উল্লেখ করে মার্কিন দূত বলেন, তারা দুজন কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না। যুক্তরাষ্ট্রও এখানে এমন একটি নির্বাচন দেখতে চায় যেখানে প্রত্যেক ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নির্বিঘ্নে তাদের ভোট দিতে পারবেন এবং তাদের প্রতিটি ভোট গণনা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে এমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত দলনিরপেক্ষ, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন। রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ ইএমকে সেন্টারে আয়োজিত ডিকাব-টক অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সম-সাময়িক প্রসঙ্গ, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, দেশটির নবনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সহযোগিতামূলক কার্যক্রম এবং টিকফা ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক আগামীর বৈঠক নিয়ে কথা বলেন।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কাজ করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের সামপ্রতিক সমস্যা যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন করে তুলেছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, ‘এ সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশসহ সমমনা সব দেশকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র।’ রাখাইন রাজ্যের মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর চলমান অভিযান ও নির্যাতনে প্রায় ২ শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। প্রায় ৩০ হাজার বাস্তুচ্যুত বা ভিটামাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আক্রান্ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আন্তর্জাতিক ওই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। এখানে প্রায় ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা দীর্ঘ দিন ধরে থাকা সত্ত্বেও সামপ্রতিক সময়ে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নতুন করে আরো কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে অস্থায়ী আশ্রয় দিয়েছে। সীমান্তের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের ঘটনায় বাংলাদেশের ওপর যে প্রভাব পড়ছে- তা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত সপ্তাহে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফ করেছেন। কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে দেশটির নবপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান এবং অস্থায়ী আশ্রয়ে থাকা মিয়ানমার নাগরিকদের নিজ ভূমে ফেরত (স্বেচ্ছায়) পাঠানোর উপায় খুঁজছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আকাঙক্ষার বিষয়ে মন্ত্রী তার ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন উল্লেখ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। তার দেশ মনে করে এ সমস্যার সমাধানে একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ ও আনুষ্ঠানিক তদন্ত হওয়া উচিত। ওয়াশিংটনের ওই অবস্থান পুনরুল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, অস্থিতিশীল ওই পরিস্থিতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তীক্ষ্ন নজর রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ওই সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ‘সতর্কতা ও দক্ষতার’ সঙ্গে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা স্মরণ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে এগিয়ে আসতে বাংলাদেশ যে আহ্বান জানিয়েছে তা অত্যন্ত ইতিবাচক। সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামপ্রতিক অভিযানের পর মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ ওই কূটনীতিক বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানে আসলে কী ঘটছে, তা আমরা জানি না। মানবিক কারণে আক্রান্ত এলাকায় ত্রাণকর্মীদের প্রবেশাধিকার নির্বিঘ্ন করার তাগিদও দেন তিনি। এ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আরো আলোচনা হবে বলে জানান তিনি।
টিকফা স্থগিত, ডিফেন্স সংলাপ ডিসেম্বরে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট-টিকফা’র ডিসেম্বরের বৈঠক স্থগিত হয়ে গেছে জানিয়ে মার্কিন দূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর ইউএসটিআর থেকে বৈঠকটি স্থগিত করা হয়েছে। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, দেশটির নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। আগামী ২০শে জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেবেন। এরপর তার প্রশাসনের অনেকে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে দায়িত্ব বুঝে নেবেন। নতুনরা আসার পর টিকফা বৈঠক পুনঃনির্ধারিত তারিখে হবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা দিনে দিনে বাড়ছে উল্লেখ করে মার্কিন দূত বলেন, আগামী ৫-৭ই ডিসেম্বর হাওয়াইতে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষাবিষয়ক (ডিফেন্স ডায়ালগ) সংলাপ হবে। সেখানে সন্ত্রাস দমনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যমান সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে। ওই সংলাপে প্রস্তাবিত লজিস্টিক সাপোর্ট এগ্রিমেন্ট নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে জানান তিনি।
অন্যান্য প্রসঙ্গ: ২০১৭ সালকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বাড়ানোর সুযোগের বছর উল্লেখ করে মার্কিন দূত বলেন, এই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার আসছে। সেখানে নতুন প্রশাসন হবে। তবে বাংলাদেশের সম্পর্কের তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে না বলে আশা করেন ওই কূটনীতিক।
বাংলাদেশ সহ দুনিয়ার দেশে দেশে সংঘটিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন দূত বলেন, বিনা বিচারে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হত্যা বিশেষ ক্ষেত্রে হতে পারে, তবে সবক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়মুক্তি দেয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের নেটওয়ার্ক, রসদসহ বিভিন্ন যোগানের তথ্য পাওয়া এবং তা যাচাই বাছাইয়ের জন্য অপরাধীদের জীবিত অবস্থায় আটক করা এবং জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম অভিবাসন বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তৃতায় যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কোনো ধর্ম বা সমপ্রদায় বিবেচনায় দেশটিতে কারও থাকা বা না থাকা নির্ধারিত হয় না। যে কোনো ধর্মের বৈধ অভিবাসীদের দেশটিতে কোনো সমস্যাই হবে না বলে জানান তিনি। ডিক্যাব সভাপতি আঙ্গুর নাহার মন্টির সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পান্থ রহমান। এতে কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতির সদস্যরা ছাড়াও বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *