ঢাকা; মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে সৃষ্ট মানবিক সঙ্কটে বাংলাদেশ সীমান্তে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে কূটনীতিকদের ব্রিফ করবে সরকার। দু’একদিনের মধ্যেই জরুরি ওই ব্রিফিং হবে বলে সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানিয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যায় এক কর্মকর্তা বলেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নৃশংস হামলা অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিরক্তও বটে। সেখানে একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা বহুদিনের উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখন আর এ নিয়ে কোন রাখঢাক করতে চাই না। এ পরিস্থিতির দায় মিয়ানমারের। বাংলাদেশ কেন বছরের বছর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে? ওই কর্মকর্তা বলেন, রাখাইন প্রদেশ থেকে মরিয়া হয়ে মানুষজন নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এ অনুপ্রবেশ বন্ধে আমাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, নারী-শিশু ও বৃদ্ধসহ মিয়ানমারের হাজার হাজার নিপীড়িত মানুষ বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম অব্যাহত রেখেছে। খবর এসেছে বিভিন্ন সীমান্ত ক্রসিং-এ আরও হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশ মিশনগুলোকে সেই সব দেশের হেড কোয়ার্টারকে ব্রিফ করতে সরকারের তরফে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দু’দিন আগেই জরুরি ওই নির্দেশনা দেয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে নিযুক্ত একজন রাষ্ট্রদূত মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে ঢাকার ওই নির্দেশ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। বলেন, সরকারের তরফে বিদেশস্থ সব মিশনকে অভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে বলা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যেকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গ্রাউন্ড রিয়েলিটি সম্পর্কে ব্রিফ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানান ওই রাষ্ট্রদূত। গত অক্টোবর থেকে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সংকট তৈরি করা হয়েছে এবং সেখানে রাষ্ট্রীয় মদত রয়েছে উল্লেখ করে সরকারি এক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারের উচিত এখনই এটি বন্ধ করতে উদ্যোগ নেয়া। মিয়ানমারের পরিস্থিতি মূল্যায়নে চলতি সপ্তাহের শুরুতে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সভাপতিত্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা মাঠ পর্যায়ের অবস্থা তুলে ধরেন। সীমান্ত খোলা রাখার ব্যাপারে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্রের বক্তব্য নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়। তবে রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে সরকার আগের অবস্থানেই রয়েছে। নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। নৌকা কিংবা বিভিন্ন মাধ্যমে যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন তাদের সঙ্গে অত্যন্ত মানবিক আচরণ করে (খাদ্য, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে) ফেরত পাঠানো হচ্ছে। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের কারণে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানাতে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে বুধবার বিকালে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সীমান্তের অখ-তা নিশ্চিতে ও রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে দেশটির নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানায় বাংলাদেশ। এ নিয়ে মিয়ানমারের গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে জড়ানোর প্রবণতার প্রতিবাদ জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবিলম্বে রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর তাগিদ দিয়েছে। দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয় বিষয়াবলি) কামরুল আহসানের কার্যালয়ে রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে প্রায় আধাঘণ্টার বেশি সময় সচিব-রাষ্ট্রদূত কথা হয়। বৈঠক শেষে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত গণমাধ্যমের মুখোমুখি হলেও এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে সচিব কামরুল আহসান মানবজমিনসহ উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের কাছে ঢাকার উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানকার লোকজনের দেশে ফিরে যাওয়ার পথ নিশ্চিত করতে আমরা তাদের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে বলেছি। আমরা স্পষ্ট করেই বলেছি, মিয়ানমারে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে যারা নির্যাতন থেকে বাঁচতে বর্ডারে এসেছে এবং বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে তারা যেন নিজ নিজ বসতভিটায় ফিরতে পারে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদূতের হাতে একটি কূটনৈতিক পত্র (এইড মেমোয়ার) দেয়া হয়েছে বলেও জানান সচিব। রোহিঙ্গাদের নিয়ে সীমান্তে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তাতে বাংলাদেশ খুব উদ্বিগ্ন জানিয়ে সচিব বলেন, আমরা মনে করি এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমারেই হওয়া উচিত। বাংলাদেশ রাখাইন অঞ্চলে হত্যা, অগ্নিসংযোগ বা কোন ধরনের নির্যাতন বাংলাদেশ দেখতে চায় না। বৈঠকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কি বলেছেন? জানতে চাইলে পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ ওই কর্মকর্তা বলেন, তারা বরাবর যা বলেন রাষ্ট্রদূতও তা-ই বলেছেন। তার দাবি- রাখাইন বিষয়ক রিপোর্টগুলো ফেব্রিকেটেট। রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য ও ছবিগুলো রাষ্ট্রদূতকে দেখানো হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নে সচিব কামরুল আহসান কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। রাতে এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সচিব মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবি বিবেচনা করে রাখাইন প্রদেশে চলমান সামরিক অভিযানের সময় বাছবিচারহীন ও অনুপাতহীন বল প্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানান। আইনের শাসন ও যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়াকে বাধাবিপত্তি ছাড়াই কাজ করতে দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে তার সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়, যাতে রাখাইন প্রদেশের মুসলিম সংখ্যালঘুরা সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য না হয়। রাখাইন প্রদেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে জরুরী পদক্ষেপ নিতেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। যাতে যারা ইতিমধ্যে সীমান্ত পেরিয়েছে ও যারা পার হওয়ার অপেক্ষায় আছে, তারা সহ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু মানুষজন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে নিজেদের গ্রামে কোন ভয় ছাড়াই নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে ফিরতে পারে। সচিব মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মানুষের করুণ দুর্দশা ও অবনতিশীল পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের ওপর এসবের প্রভাব নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেন।